
অথবা, ভাষা আন্দোলনের পিছনের কারণগুলো সংক্ষেপে মূল্যায়ন কর।
অথবা, ভাষা আন্দোলনের কারণসমূহ আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: ভাষা আন্দোলনের পিছনে প্রধান কারণ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি হলেও এর পশ্চাতে আরো কতকগুলো বিষয় জড়িত। বস্তুত পাকিস্তানের পূর্ব অংশের প্রতি পশ্চিম অংশের বৈষম্যমূলক মনোভাবের সমুচিত জবাব দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ভাষা আন্দোলনের উৎপত্তি ঘটেছিল।
করা হলো:
ভাষা আন্দোলনের পশ্চাতে কারণ: নিচে ভাষা আন্দোলনের পিছনের কারণগুলো সংক্ষেপে আলোচনা
১. ভাষা বিতর্ক: পাকিস্তান পূর্ব ভাষা বিতর্কের ধারাবাহিকতায় নতুন রাষ্ট্রের রাজধানী করাচিতে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এর ফলে পূর্ব বাংলার বুদ্ধিজীবী মহল ব্যাপকভাবে বিক্ষুদ্ধ হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করে প্রত্যাখ্যাত হন। ফলে পূর্ব বাংলায় শুরু হয় মিছিল, হরতাল ও ধর্মঘট।
২. বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা: ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলার সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঐক্য আসে। ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় বিভিন্ন সংগঠন। এর মধ্যে গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমদ্দুন মজলিশ, আওয়ামী মুসলিম লীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব সংগঠনের মাধ্যমে বাঙালি তাদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া পাকিস্তানিদের সামনে উত্থাপন করতে পেরেছিল।
৩. জিন্নাহর ঢাকা ঘোষণা: ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মুহম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্সের ময়দানে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন, “Urdu and Urdu shall be the state language of Pakistan.” এ ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে বাংলার ছাত্রসমাজ। তেমনিভাবে ২৪ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে জিন্নাহ একই ঘোষণা দিলে ছাত্ররা ‘না’ ‘না’ ফধ্বনি দ্বারা এর প্রতিবাদ করেন।
৪. খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণা: খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সাথে সাথে ঘোষণা দেন “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” এর প্রতিবাদে বাংলার জনতা ফুঁসে উঠে এবং সংঘটিত হয় ভাষা আন্দোলন।
৫. গণপরিষদে বিল পাস: উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব সংবলিত একটি বিল পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশনে পাস করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলার শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে ফুঁসে উঠেছিল।
৬. উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতাদের অধিকাংশ ছিলেন উর্দুভাষী। স্বভাবতই পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করে তারা উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিমুদ্দিনসহ মুসলিম লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ঘোষণা দেন। ফলশ্রুতিতে সংঘটিত হয় ভাষা আন্দোলন।
৭. সাংস্কৃতিক কারণ: কোনো জাতির ভাষার উপর আঘাত করা মানে ঐ জাতির পুরো সংস্কৃতির উপর আঘাত করা। পৃথক বাঙালি সত্তাকে ধ্বংস করাই ছিল পাকিস্তানিদের মূল লক্ষ্য। আর এজন্য তারা ভাষার উপর আঘাত করেছিল। তবে বাঙালি তার পৃথক সত্তাকে রক্ষা করার উদ্দেশ্য তমদ্দুন মজলিশসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল।
৮. অর্থনৈতিক কারণ: নানা ধরনের বৈষম্য দূর ও চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা ১৯৪৯ সালে ধর্মঘট পালন করে। আর তাদের সাথে যোগ দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা। শুধু সরকারি কর্মচারীরা নয় বরং বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা নানাভাবে শোষিত হচ্ছিল। আর এ শোষণের কারণেই বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভাষা আন্দোলনে যোগদান করেছিল বলে ভাষা আন্দোলন গবেষক বদরুদ্দীন উমর মনে করেন।
৯. রাজনৈতিক কারণ: প্রথমদিকে ভাষা আন্দোলন সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে পরিচালিত হলেও পরবর্তীতে এটি একটি রাজনৈতিক চরিত্র পায়। বাংলার বিভিন্ন দলের পার্লামেন্টের সদস্যরা শুরু হতেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে পার্লামেন্টে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ফলে এ আন্দোলন রাজনৈতিক দাবি আদায়ের প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হতে থাকে।
উপসংহার: আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি যে, শুধু ভাষার প্রশ্নই নয় বরং ভাষা আন্দোলনের পিছনে আরো নানা কারণ বিদ্যমান ছিল। এসব নানাবিধ কারণই ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে বাঙালিকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।