অথবা, মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় কী কী বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়? আলোচনা কর।
অথবা, মধ্যযুগ ছিল অন্ধকার, অরাজনৈতিক ও ধর্মীয় গোড়ামির ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।”- ‘উক্তিটির আলোকে মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য তুলে ধর।
উত্তরঃ ভূমিকা: রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসকে মোটামুটিভাবে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করার রেওয়াজ সর্বজনস্বীকৃত। এগুলো হচ্ছে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে মধ্যযুগ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মধ্যযুগের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের ভাঙা-গড়ার ইতিহাস। রোমান যুগের পর তথাকথিত অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগের শুরু হয় এবং প্রায় ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে মধ্যযুগ বিস্তৃত। এ অন্ধকার যুগ হেলেনিজম, রোমান, রাজনৈতিক সমাজ ও সংগঠন, খ্রিস্টীয় চার্চ প্রভৃতির সংমিশ্রণের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এ সময় ধর্মীয় বিশ্বাসের সময়। এ সময় যুক্তিতর্কের চেয়ে ধর্মীয় গোঁড়ামির উপর বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়।
মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তা: রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে কোন সময়কে মধ্যযুগ বলা হয় সে বিষয়ে যয়েই মতভেদ থাকলেও মোটামুটিভাবে ইউরোপের ইতিহাসে ষষ্ঠ শতাব্দী হতে ষোড়শ শতাব্দীকালকেই মধ্যযুগ বলা হয়। বস্তুত বর্বর। জার্মান জাতি কর্তৃক রোম সাম্রাজ্যের পতনের অব্যবহিত পরেই মধ্যযুগের সূচনা হয়। এ যুগের রাজনৈতিক দর্শনের উপর। প্রস্তণ্য করতে গিয়ে কোন কোন লেখক এ যুগকে অবাজনৈতিক বলে মন্তব্য করেছেন। সাধারণত ৪০০ সাল থেকে ১৪০০ সাল পর্যন্ত সময়কে মধ্যযুগ বলা হয়। ৪০০ সালের আগ পর্যন্ত ইউরোপে রোমানদের আবিপতা ছিল। তারপর বাইরের নানা জাতির আক্রমণে এ বিশাল সাম্রাজ্য ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৪০০ সালের পর সংস্কার আন্দোলন, নবজাগরণ এবং অন্যান্য কয়েকটি নতুন ভাবধারা আবির্ভাব হয় রাজনীতির উপর। এদের সুস্পষ্ট প্রভাব পড়ে বলে ১৪০০ সালের পরে আমরা নতুন রাজনৈতিক চিন্তাধারা লক্ষ্য করি। অধ্যাপক সেবাইন (Sabino) এর মতে, “খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত গির্জায়। ধর্মযাজকদের যে যুগ, তা এখনো প্রাচীন যুণেরই অংশ। খ্রিস্টধর্মের প্রথম ছয়শত বছরে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রকৃত পরিবর্তন সাধিত হওয়া সত্ত্বেও সিনেকা ও সেন্ট গ্রেগরি উভয়ই রোমান ঐতিহ্যের ধারক।”
মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্যসমূহ: রাজনৈতিকমুক্ত, অবৈজ্ঞানিক ও অসৃজনশীল মধ্যযুগের বেশকিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। এ বৈশিষ্ট্যসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হলো:
১. বিশ্বজনীনতা: মধ্যযুগের চিভাধারার অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো বিশ্বজনীনতা। সমগ্র বিশ্বজুড়ে যে এক সমাজ এ ধারণা সমগ্র মধ্যযুগব্যাপী প্রাণবস্তু ছিল।
২. স্টোচিকনাদের প্রতাব: মধ্যযুগের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় স্টোয়িকবাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। স্টোয়িকাদের ন্যায় মধ্যযুগের রাজনৈতিক দর্শনও প্রাকৃতিক আইন, ঈশ্বরের শাসন, সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান ইত্যাদি ধারণার আস্থাবান ছিল।
৩. প্রশাসনিক দুর্বলতা: দেখা যায় সাম্রাজ্যে জার্মানদের প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণেই সুষ্ঠু রাষ্ট্র চর্চার বিকাশ হয় নি। এখানে প্রশাসনে কোন সুষ্ঠু নিয়মনীতি ছিল না। ফলে প্রশাসন ব্যবস্থা বিকাশ করা অসম্ভব ছিল।
৪. পোপের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি: আধ্যাত্মিক ক্ষেত্র অতিক্রম করে চার্চের পোপেরা জাগতিক ব্যাপারে বিশেষত সম্রাটদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলে মুক্ত রাষ্ট্র চর্চা বন্ধ হয়ে যায়।
৫. ধর্মীয় আধিপত্য: জাগতিক ব্যাপারে ধর্মীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে রাজনীতি ধর্মীয় গহারে বন্দি হয়ে পড়ে। মধ্যযুগ এ অবস্থার শিকার হয়েছিল।
৬. দুর্ধর্ষ দস্যুদের আক্রমণ: রোম জয়ের পর হতে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত লোসার্ডের ন্যায় দুর্ধর্ষ দস্যুদের আক্রমণে ইউরোপের প্রায় সর্বত্র আইনশৃঙ্খলার দারুণ অবনতি ঘটে যা রাজনীতিতে বিরাটশন সূরি হয়।
৭. সামন্তবাদ: সামন্তবাদ ছিল মধ্যযুগের টিউটনদের সর্বশ্রেষ্ঠ অ-বান। সামন্তবাদ ছিল মধ্যযুগের অন্যতম বৈশিটা। অধ্যাপক সেবাইনের ভাষায়, ‘নগররাষ্ট্র যেমন প্রাচীন যুগে কর্তৃত্ব করতো তেমনি সামন্তবাদও মধ্যযুগে প্রভাব বিস্তার করতো।”
৮. রাজনীতি বিষয়ক পুস্তকের স্বল্পতা: পুস্তকের বিরলতা রাজনীতিতে এক অন্যতম বাধা হিসেবে দেখা দেয়। যদিও কিছু লেখা প্রকাশিত হতো, তা প্রাচীন লেখার পুনরাবৃত্তি।
৯. খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্য: অধ্যাপক ডানিং বলেছেন, রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে মধ্যযুগের ইতিহাসের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউরোপে রোমান সাম্রাজ্যের বাইরেও খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠা করা ও গির্জার অগ্রগতি সাধন করা।
১০. সাম্রাজ্য: মধ্যযুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সাম্রাজ্য। রোম সাম্রাজ্যের পতনের পরও যুগে যুগে রোম সাম্রাজ্যের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করছে।
১১. মধ্যযুগের রাষ্ট্রতত্ত্ব: মধ্যযুগের রাষ্ট্রতত্ত্ব ছিল এক উষর মরুভূমি। সম্রাট ও পোপের কর্তৃত্ব দ্বন্দ্বের ধূলিঝড়ে অশান্ত। সেখানেও রাজতন্ত্র বা শান্তিতন্ত্র ছিল অজানা।
১২. গির্জা ও রাষ্ট্রের মতবিরোধ: গির্জা ও রাষ্ট্রের মতবিরোধই মধ্যযুগের রাষ্ট্রদর্শনে পরিব্যাপ্ত ছিল। একদিকে গির্জার পুরোহিত এবং অন্যদিকে রাষ্ট্রের সম্রাট ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জীবনই নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট হয়েছিল। ফলে উন্নয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে পারস্পরিক কলহ ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এ দ্বন্দ্বে গির্জাই জয়ী হয় এবং ক্রমে এর ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। । ফলে সে যুগে অরাজড়তা সৃষ্টি হয়।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রতত্ত্বের অনুপস্থিতি, স্টয়িকবাদের প্রভাব গীর্জা ও রাষ্ট্রের মতবিরোধ প্রভৃতি ছিল মধ্যযুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সে সময় মানুষের সকল আচরণ ছিল ধর্ম নির্ভর। মধ্যযুগে যুক্তির দিক থেকে ধর্মীয় বিশ্বাসই ছিল প্রবল। তখন ধর্ম ও’ রাজনীতি ছিল একই সূত্রে গাঁথা। মূলত মধ্যযুগ হিল অন্ধকার, অরাজনৈতিক ও ধর্মীয় গোড়ামির ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।