অথবা, মধ্যযুগ ছিল অরাজনৈতিক- আলোচনা কর।
অথবা, মধ্যযুগ অরাজনৈতিক থাকার কারণগুলো আলোচনা কর।
অথবা, মধ্যযুগ কেন অরাজনৈতিক? যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দাও।
উত্তরঃ ভূমিকা: স্বতন্ত্রভাবে রাজনৈতিক চেতনা ও রাষ্ট্রতত্ত্বের অনুপস্থিতি এবং ধর্মীয় প্রভাবের কারণেই মূলর মধ্যযুগ ছিল অরাজনৈতিক ও অবৈজ্ঞানিক। এ সময় রাষ্ট্রকে ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাবা হতো। Hearnshaw এজন্য বলেছেন, “The political theory of the middle ages may sometimes appeare like a desert, often disturbed by the sand storm raised by the conflicting genies of papacy and Empire.”
মধ্যযুগ অরাজনৈতিক- এর পক্ষে যুক্তি: মধ্যযুগ অরাজনৈতিক থাকার বিভিন্ন কারণ নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. রাষ্ট্রতত্ত্বের অনুপস্থিতি ও ধর্মীয় চেতনার প্রভাব: প্রথমদিকে মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা শুধু ধর্মীয় চিন্তাধারার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল। পার্থিব জগৎ ও রাজনৈতিক বিষয়াদির ব্যাপারে এটি কখনো মনোনিবেশ করে নি। রাষ্ট্রতত্ত্ব সংক্রান্ত কোন বিষয় মধ্যযুগীয় চিন্তাধারার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এ যুগে রাজনীতিকে একটি পৃথক বিষয় হিসেবে মনে করা হয় নি। বস্তুত মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক মতবাদ গির্জা, রোমান সাম্রাজ্য, সামন্তবাদ এবং জাতীয়তাবাদের পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলস্বরূপ। এজন্য অধ্যাপক ডানিং বলেছেন, “মধ্যযুগ ছিল অরাজনৈতিক।”
২. টিউটন আতির আক্রমণ: মধ্যযুগে রোমান সভ্যতা বিশ্বদরবারে সম্মানের আসন অলংকৃত করতে সমর্থ হয়েছিল। তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির উৎকর্ষতায় সমগ্র বিশ্ববাসী হয়েছিল অভিভূত ও বিমোহিত এবং রোমানদের দেখিয়েছিল অজস্র সম্মান। কিন্তু বর্বর জার্মান বা টিউটন জাতির আক্রমণে তাদের শৌর্যবীর্য সব নিক্ষেপিত হয় মহাকালের অতল গহ্বরে। ফলে ক্রমান্বয়ে অরাজনৈতিকতা বৃদ্ধি পায় এবং মুক্ত রাজনৈতিক দর্শন সময়ের স্রোতে বিলীন হয়ে যায়।
৩. স্টোয়িকবাদের প্রভাব: মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারাতে স্টোয়িকবাদের যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান ছিল। স্টোয়িকবাদের ন্যায় মধ্যযুগের রাজনৈতিক দর্শন ও প্রাকৃতিক আইন, ঐশ্বরিক শাসন, সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান প্রভৃতি ধারণায় আস্থাবান ছিল, যা অনেকটা অবৈজ্ঞানিক ও অরাজনৈতিক ধারণা।
৪. খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্য: মধ্যযুগে খ্রিস্টধর্মের এত বেশি প্রাধান্য ছিল যে, কোন মানুষ এর গণ্ডি বহির্ভূত কোন চিন্তার অবকাশ পায় নি। ফলে আবিষ্কার বা উদ্ভাবন বন্ধ হয়ে পড়েছিল। মানুষকে কেবল বাইবেল নির্দেশিত পথে চলতে বাধ্য করা হতো। অধ্যাপক ডানিং তাই বলেছেন, “রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে মধ্যযুগের ইতিহাসের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউরোপে রোমান সাম্রাজ্যের বাইরেও খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠা করা এবং গির্জার অগ্রগতি সাধন করা। ফলে রাজনীতির ক্ষেত্রে অরাজকতা বা বন্ধ্যাত্বের সৃষ্টি হয়।
৫. গির্জার ক্ষমতা বৃদ্ধি: মধ্যযুগে গির্জার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পোপের ত্রুটিমুক্ত ও পক্ষপাতমুক্ত শাসনব্যবস্থা স্বেচ্ছাচারী শাসককে নিয়ন্ত্রণ করতো এবং এক্ষেত্রে কোন বিরোধ ছিল না। ক্রমে গির্জার ক্ষমতার প্রতি জনগণের আসক্তি জন্মে। ফলে গির্জার সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটল। এভাবে গির্জার ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ধর্মযাজকদের রাজনীতিতে বাধ্য করা হলো। গির্জার ক্ষমতা বৃদ্ধি মধ্যযুগে সুষ্ঠু রাজনীতি বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
৬. গির্জা ও রাষ্ট্রের মতবিরোধ: গির্জা ও রাষ্ট্রের মতবিরোধই মধ্যযুগের রাষ্ট্রদর্শনে পরিব্যাপ্ত ছিল। একদিকে গির্জার পুরোহিত এবং অন্যদিকে রাষ্ট্রের সম্রাট ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জীবনই নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট হয়েছিল। ফলে উভয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে পারস্পরিক কলহ ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এ দ্বন্দ্বে গির্জাই জয়ী হয় এবং ক্রমে এর ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে সে যুগে অরাজকতা সৃষ্টি হয়।
৭. পোপতন্ত্র: মধ্যযুগের প্রথম পর্বে পোপ তার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নতুন টেস্টামেন্ট অপেক্ষা পুরাতন টেস্টামেন্টকে অধিকতর উপযোগী বলে প্রচার করায় পুরোহিততন্ত্র বা যাজকতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কেননা পুরাতন টেস্টামেন্টের শিক্ষা অনুযায়ী আইন হচ্ছে খোদার ইচ্ছার অভিব্যক্তি এবং রাজা ও রাজকর্মচারীদের ক্ষমতা সীমিত, পোপের ক্ষমতাই মুখ্য, যা অনেকটা অবৈজ্ঞানিক ও অরাজনৈতিক ব্যাপার বলে গণ্য করা হয়।
৮. রাজনীতি সম্পর্কিত রচনার স্বল্পতা: মধ্যযুগে রাজনীতি সম্পর্কিত মৌলিক কোন রচনা বা পুস্তক ছিল না। দু’একটি রচনা প্রকাশিত হলেও তাতে প্রাচীন যুগের রাষ্ট্রদর্শনের পুনরাবৃত্তি লক্ষণীয়। সেন্ট অগাস্টিন ও সেন্ট টমাস একুইনাসের রাষ্ট্রদর্শন উল্লেখযোগ্য হলেও তা ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। ফলে মধ্যযুগ ছিল অরাজনৈতিক।
৯. দুই তরবারি তত্ত্ব: মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিভার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল ‘দুই তরবারি তত্ত্ব’। অধ্যাপক ডানিং এর মতে, “The starting point in all medieval the orizing on politics was the dogma of the two powers.” পার্থিব বিষয়ের শাসক ছিলেন রাজা এবং অপার্থিব বিষয়ের শাসক ছিলেন পোপ। এটাই হলো ‘দুই তরবারি তত্ত্ব’। এ তত্ত্বকে উভয়ের মধ্যকার মীমাংসার উপায় বলে মনে করতেন। কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকরী ছিল না। তাই সমগ্র মধ্যযুগ জুড়ে পোপ ও রাজার সংঘর্যের কারণে অরাজকতা ও অরাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো রাজশক্তি ও গির্জার ক্ষমতা ও আধিপত্যের দ্বন্দ্ব। মধ্যযুগের আরেকটি লক্ষণীয় দিক ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ধর্মীয় চিন্তাচেতনার প্রভাব। সবকিছুই চিন্তা করা হতো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। যুক্তিতর্কের পর্যবেক্ষণের কোন স্থান ছিল না।