অথবা, মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর। এ পরিকল্পনা কেন ব্যর্থ হয়েছিল?
অথবা, মন্ত্রিমিশন (১৯৪৬) পরিকল্পনার প্রস্তাবসমূহ পর্যালোচনা কর। এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় কেন?
উত্তর: ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে ভারতবর্ষে বিভিন্ন কারণে অনেক আন্দোলন সংগ্রামের সূত্রপাত হয়। ব্রিটিশ সরকার কখনও শক্তি প্রয়োগ করে কখনও আবার আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এসব আন্দোলনকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতীয়গণ অনুভব করেছিলেন যে, ব্রিটিশদের পক্ষে আর শান্তিপূর্ণভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করা আর সম্ভব নয়। এটলির ঘোষণায় ১৯৪৬ সালে ১৯ ফেব্রুয়ারি মাসে ভবিষ্যৎ সংবিধান নিয়ে আলাপ আলোচনার জন্য একটি মিশন পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আর এ মিশনে তিনজন সদস্য ছিলেন লর্ড প্যাথিক লরেন্স, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ও লর্ড এ.ভি আলেকজান্ডার। এ মিশন ভারতের শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা নিয়ে বিভিন্ন দলের সাথে আলোচনা করেন। কিন্তু বিভিন্ন দলের সাথে ঐকমত্য না হওয়ায় নিজেদের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন যা মন্ত্রিমিশন নামে বিশেষ পরিচিত।
মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য: মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী ও তাৎপর্যপূর্ণ:
নিম্নে এ পরিকল্পনার প্রস্তাবগুলোর তিনটি প্রধান অংশ দেওয়া হলো:
(ক) গণপরিষদ সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ,
(খ) ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কিত সুপারিশসমূহ এবং
(গ) অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্পর্কিত ঘোষণা।
(ক) গণপরিষদ সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ: মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার
গণপরিষদ সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ নিম্নরূপ:
১. সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ কমিটি গঠন করা হবে। গণপরিষদের এসব সদস্যগণ জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যদের দ্বারা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হবে।
২. এভাবে গণপরিষদ গঠিত হওয়ার পর একজন সভাপতি ও অন্যান্য পদাধিকারীদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে এ সভার কার্যপ্রণালি আলোচিত হবে।
(খ) ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কিত সুপারিশসমূহ:
মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কিত সুপারিশসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. এই পরিকল্পনায় ইউনিয়নের হাতে পদত্ত বিষয়গুলো ছাড়া অন্যান্য সকল বিষয় প্রদেশগুলোর হাতে অর্পণ থাকবে।
২. প্রদেশগুলোর অনুরূপ ক্ষমতা দেশীয় রাজ্যগুলোও ভোগ করবে।
৩. মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনায় ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলো নিয়ে ভারত ইউনিয়ন গঠনের প্রস্তাব করা হয়। ভারত ইউনিয়নের হাতে পরারাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ সম্পর্কিত সকল বিষয় অর্পিত থাকবে।
৪. এছাড়া আরো বলা হয়, ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে ভারত ইউনিয়নের শাসন বিভাগ ও আইনসভা গঠিত হয়।
৫. মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনায় ভারতের প্রদেশগুলোকে ৩টি বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করা হবে। যেমন-
(ক) গ্রুপ মাদ্রাজ, বোম্বাই, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও উড়িষ্যা-এই ৬টি প্রদেশ নিয়ে গঠিত হবে।
(খ) উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব ও সিন্ধু এ প্রদেশগুলো নিয়ে গঠিত হবে।
(গ) বাংলা ও আসাম পূর্ব ভারতের মুসলমান প্রধান প্রদেশ দুটি নিয়ে গঠিত হবে।
(ঘ) সংবিধান রচনা হওয়ার পর যে-কোনো প্রদেশ ইচ্ছে করলেই গ্রুপ থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
৬. প্রত্যেকটি গ্রুপ তাদের ইচ্ছানুযায়ী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং শাসন সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতে পারবে।
৭. যে-কোনো প্রদেশ তার আইনসভার অধিকাংশ সদস্যদের সম্মতিক্রমে সংবিধানের বিধানসমূহ পুনঃবিবেচনা করতে পারবে।
(গ) অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন: ১৯৪৬ সালের মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথাও উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, নতুন সংবিধান প্রণীত ও প্রবর্তিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন পরিচালনার জন্যে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে কেন্দ্রে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে।
মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার ব্যর্থতা: মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা যে উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছিল শেষ পর্যন্ত তা নানা কারণে ব্যর্থ হয়। গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াডেল অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে মুসলিম লীগকে কংগ্রেসের সমান সংখ্যক সদস্যপদ দানে সম্মত হয়। তিন সদস্যবিশিষ্ট মিশন ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনার পর ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে তারা নিজেদের পরিকল্পনা ঘোষণা দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার ব্যর্থ হয়। মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা ছিল বিভিন্ন মেয়াদি প্রস্তাব সম্বলিত। প্রথমদিকে মুসলিম লীগ মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা মোতাবেক অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও লর্ড ওয়াভেল তার চুক্তি ভঙ্গ করলে মুসলিম লীগ তার এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়। অন্যদিকে কংগ্রেসের নবানির্বাচিত সভাপতি জহরলাল নেহেরু সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ক্যাবিনেট মিশনে যোগদানের কথা। অপরদিকে বড়লাট ওয়াভেল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদানের জন্য নেহেরু ও জিন্নাহকে আমন্ত্রণ জানান। নেহেরুর বক্তব্যের পর মুসলিম লীগ পূর্বের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর লর্ড ওয়েভেলের প্রস্তাব অনুযায়ী কংগ্রেস অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়। মুসলিম লীগ এর প্রতিবাদস্বরূপ ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ কর্মপন্থা দিবস পালন করে। দুই বড় রাজনৈতিক দলের এরকম সিদ্ধান্তে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যায়। এ রকম বিপদামুখী পর্যায়ে লর্ড ওয়াভেলের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে মুসলিম লীগ লিয়াকত আলী খানের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দেয়। অবশেষে বহু বাধা অতিক্রম করে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃতে কেন্দ্রে সরকার গঠিত হয় সত্য কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকরী হয় না। কারণ গ্রুপিং ব্যবস্থা নিয়ে উভয় দলের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়। সব জায়গায় মুসলিম লীগ অসহযোগিতার মাধ্যমে একটি নৈরাজ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার বৈঠকের আহবান জানান দুই দলকেই। কিন্তু মুসলিম লীগ কোনোক্রমেই এ সভায় যোগ দেয় না। ফলে উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ, বৈরি মনোভাব, অবিশ্বাস আরো বেড়ে যায় এবং অবশেষে মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে বাধ্য হয়।
উপসংহার: অবশেষে বলা যায় যে, মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়া সত্ত্বেও তদানীন্তন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে মন্ত্রিমিশনের প্রস্তাবগুলোর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা প্রথমবারের মতো শুধু ভারতীয় সদস্যদের নিয়ে গণপরিষদ গঠনের ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল, যা ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি স্বরণীয় অধ্যায়।