
অথবা, মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনা কী? মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: ব্রিটিশ সরকার ভারতে শাসনতান্ত্রিক সমস্যাবলি সমাধানের জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ
করেছিল তার মধ্যে লর্ড মাউন্ট ব্যাটের পারিকল্পনা ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন যখন চরম রূপ ধারণ করে তখন ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে যে ব্রিটিশদের পক্ষে ভারতের শাসনব্যবস্থা সন্তোষজনকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। ফলে ব্রিটিশ সরকার সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য ১৯৪৭ সালে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে বড় লাটের দায়িত্ব দেন। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন বড় লাটের দায়িত্ব নিয়ে ভারত সম্পর্কিত যে পরিকল্পনা গ্রহণ করে তাই মাউন্ট ব্যাটেদ পরিকল্পনা। ভারত স্বাধীনতা আইনে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনা: ১৯৪৬ সালের মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর সমগ্র ভারতে সাম্প্রদায়িক
দাঙ্গা ও হাঙ্গামার সূত্রপাত হয়। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে অবিশ্বাস, সন্দেহ ও মতানৈক্যের কারণে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় ১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ মাউন্ট ব্যাটেন ভারতের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি ভারতে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য ভারতের মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনা শুরু করেন। দুটি দল দু’ধরনের বক্তব্য পেশ করে। মুসলিম লীগ ভারত বিভক্তির প্রস্তাব পেশ করে এবং কংগ্রেস অবিভক্ত ভারত প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা এমন চরম অবস্থানে পৌঁছেছিল যে পূর্ব পরিস্থিতির ভয়াবহতা পর্যবেক্ষণ করে গান্ধীজি শেষ পর্যন্ত ভারত বিভক্তিতে সম্মতি জ্ঞাপন করে। ভারতের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল যখন প্রায় বিভক্তি নিয়ে ঐকমতা তখন বড়লাট মাউন্ট ব্যাটেন তার উপদেষ্টার সাথে পরার্মশ ক্রমে একটি শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এ পরিকল্পনায় ভারতে প্রদেশগুলোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় এবং প্রদেশগুলো ইচ্ছা করলে Confederation গঠন করতে পারবে। পরিকল্পনায় পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাগের প্রস্তাব করা হয়। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ব্রিটিশ সরকার এ পরিকল্পনা ঘোষণা করে এটিই মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনা।
মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য: মাউন্ট ব্যাটেন ১৯৪৭ সালের ১৮ মে লন্ডনে যান এবং পরিকল্পনাটি ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদনের পর ভারতে প্রত্যাবর্তন করে। ২ জুন বড় পরিকল্পনাটি নিয়ে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও শিখ নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করেন। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন পরিকল্পনাটি জন সম্মুখে প্রকাশ করে। নিচে এটি বর্ণনা করা হলো:
১. ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পাবে। কিন্তু ভারতবর্ষকে ধর্মের ভিত্তিতে দুটি অংশে বিভক্ত করে। স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবে।
২. বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশের জেলাগুলোকে সম্প্রদায়ভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার আলোকে বিভক্ত করা হবে।
৩. গণভোটের মাধ্যমে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বেলুচিস্তান এবং আসামের সিলেট জেলা পাকিস্তানে যোগ দেবে কি না স্থির হবে।
৪. ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি সীমানা কমিশন গঠন করা হবে।
৫. ভারতবর্ষকে ডোমেনিয়ন স্টেটাস প্রদানের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি সুনিদিষ্ট আইন প্রণয়ন করা হবে।
৬. ভারত ও পাকিস্তান কমনওয়েলথভুক্ত থাকবে কি থাকবে না সে সম্পার্ক স্ব-স্ব রাষ্ট্রের গণপরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
৭. এ পরিকল্পনা কেবল ব্রিটিশ ভারতের ক্ষেত্রেই কার্যকরি হবে। দেশীয় রাজ্যগুলোর প্রতি ব্রিটিশ সরকারের ঘোষিত নীতি অপরিবর্তিত থাকবে।
৮. কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই ৩ জুনের পরিকল্পনাটি গ্রহণ করে।
আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সিন্ধু ও বেলুচিস্তান প্রদেশ পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষে রায় প্রদান করে। উত্তর পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশ গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষে রায় ঘোষণা করে। জুলাই মাসে আসামের সিলেট জেলায় গণভোট হয় এবং তারা পূর্ব বাংলায় যোগদানের পক্ষে ভোট দেয়। পাঞ্জাব ও বাংলায় সীমানা বিভাজনের জন্য সিরিল র্যাডক্লিফ এর নেতৃত্বে একটি সীমানা কমিশন গঠিত হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ব্রিটিশ ভারতে মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনা একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা ছিল। এ পরিকল্পনা দ্বারা ভারতের রাজনৈতিক অচল অবস্থা অনেকাংশে নিরসন হয়। মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনার আলোকে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন প্রণয়ন করে। ফলে ভারতবর্ষে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে।