মুক্তিযুদ্ধের নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনী সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, মুক্তিযুদ্ধের নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনী সম্পর্কে যা জান লিখ।

উত্তর। ভূমিকা: মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের অহংকার। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এ যুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সাথে অনিয়মিত বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। নিচে মুক্তিযুদ্ধের নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনী সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

নিয়মিত বাহিনী: মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর ছাড়াও তিনটি ব্রিগেড আকারের ফোর্স ছিল। যথা। ‘জেড’ ফোর্স, ‘কে’ ফোর্স এবং ‘এস’ ফোর্স। এ ফোর্স তিনটি নিয়ে নিয়মিত বাহিনী গড়ে উঠেছিল। নিচে এ ফোর্সের দায়িত্বে নিয়োজিত সামরিক অফিসারদের নাম উল্লেখ করা হলো।

‘জেড’ ফোর্স: এ ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান।

‘কে’ ফোর্স: প্রথমে লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ এ ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন এবং খালেদ মোশাররফ গুরুত্বর আহত হলে মেজর আবু খালেক চৌধুরী অস্থায়ীভাবে এর অধিনায়ক হন।

‘এস’ ফোর্স: মেজর পরে লে. কর্নেল কে. এম. শফিউল্লাহ ছিলেন এ ফোর্সের অধিনায়ক। অনিয়মিত বাহিনী বা ফ্রিডম ফাইটার্স (এফ.এফ.): ছাত্র-যুবকদের নিয়েই অনিয়মিত বাহিনী গঠিত হয়। গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার জন্য এদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। এদেরকে বলা হতো ফ্রিডম ফাইটার্স সরকারি নাম ছিল অনিয়মিত বাহিনী বা গণবাহিনী।

সুজিব বাহিনী: মুজিব বাহিনীর জন্ম ভারতে। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের বাছাই করা তরুণ এবং শিক্ষিত তরুণদের নিয়ে এ বাহিনী গড়ে উঠেছিল। এ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন তোফায়েল আহম্মেদ, শেখ ফজলুল হক মণি, আব্দুর রাজ্জাক ও সিরাজুল আলম খান। বাংলাদেশ সরকার এবং সেক্টর কমান্ডারদের অজান্তে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এ বাহিনীর জন্ম হয়।

আফসার বাহিনী: মেজর আফসারউদ্দীন আহমেদ ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থানার মল্লিকবাড়ি গ্রামে একটিমাত্র রাইফেল নিয়ে তাঁর বাহিনী গঠন করেন। তার বাহিনীতে প্রায় সাড়ে চার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ভালুকা থানার বাজু এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে একটানা ৪৮ ঘণ্টা যুদ্ধ করে আফসার বাহিনী কৃতিত্বের পরিচয় দেয়।

কাদেরিয়া বাহিনী: বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইল অঞ্চলে এক দুর্ধর্ষ বাহিনী গড়ে উঠে, যা ‘কাদেরিয়া বাহিনী’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের ভিতর থেকে এরা তাদের নিজস্ব নিয়মে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদের বাহিনীতে প্রায় সাড়ে তিনশর বেশি সৈন্য ছিল। এরা প্রায় সহস্রাধিক পাকিস্তানি সৈন্য খতম করে। অপরপক্ষে, এদের মাত্র একত্রিশ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারায়। পাক হানাদার বাহিনীর কাছে কাদেরিয়া বাহিনী ছিল মহাআতঙ্ক।

হেমায়েত বাহিনী: হেমায়েতউদ্দীন ছিলেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন হাবিলদার। ২৯ মে বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার বাটরা বাজারে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে তার বাহিনী উদ্ভোধন করেন। হেমায়েত বাহিনী জুন মাসের মধ্যেই ফরিদপুর ও বরিশালের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করেন। এ বাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই গড়ে উঠেছিল এবং এর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৫,০৫৪ জন।

বাংলাদেশ নৌবাহিনী: মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এজন্য কলকাতা পোর্ট কমিশনারের নিকট থেকে এম.ভি. পদ্মা এবং এম.ডি. পলাশ নামে দুটি জাহাজ সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি জাহাজে দুটি করে ৪০ মিলিমিটার কামান স্থাপন করা হয় এবং ৩৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে জাহাজ দুটিকে নৌ-যুদ্ধের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। পাকিস্তান থেকে ৪৫ জন পালিয়ে আসা নৌ সেনা নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর গোড়াপত্তন হয়। নভেম্বর পর্যন্ত ৮৬০ জন নৌকমান্ডোকে ট্রেনিং দেওয়া হয়। এরা অনেক সফল অভিযান ঢালিয়ে কোস্টার, ট্যাংকার, টাগ ও বড় জাহাজের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। এছাড়া ১৪ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে কমান্ডো অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানের সম্ভার বহনকারী জাহাজ এম.ডি. আল আব্বাস ও এম.ভি. হরমুজ ডুবিয়ে দিয়েছিল। ডিসেম্বর পর্যন্ত নৌ অভিযান চালানোর ফলে পাকিস্তানিদের ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ৪০ কোটি টাকার মতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর গানবোট ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ মংলা বন্দর আক্রমণের উদ্দেশ্যে খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছাকাছি পৌছালে ভারতীয় বিমানবাহিনীর গোলার আঘাতে বিধ্বস্ত হয়।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনী: মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যায়ে ২৮ সেপ্টেম্বর ডিমাপুরে এয়ার কমোডর এ. কে. খন্দকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বাহিনীর জন্ম হয়। ভারত থেকে পাওয়া একটি ডাকোটা, একটি অটার বিপন এবং একটি এল্যুয়েট হেলিকপ্টার দিয়েই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়েছিল। এগুলোতে বসানো হয় ৩০৩ ব্রাউনিং মেশিন গান এবং বোঝাই করা হয় কিছু রকেট ও ২৫ পাউন্ডের বোমা। প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন পি.আই.এ. থেকে ডিফেক্ট কর। ছ’জন বাঙালি পাইলট। ৩ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকা ও চট্টগ্রামে যেসব আক্রমণ ধারা রচনা করেছিল তার প্রথম আক্রমণের কৃতিত্বের দাবিদার বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। ঢাকা পতন বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রায় বারো বারের বেশি পাকিস্তানি লক্ষ্যবস্তুর উপর আক্রমণ চালিয়েছিল।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উপর্যুক্ত সামরিক সংগঠনসমূহের অক্লান্ত পরিশ্রম ও জীবনের বিনিয়ে দীর্ঘ ৯ মাসের সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে উপর্যুক্ত সামরিক সংগঠন ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা এবং বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।