অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি ও বিশ্বের বিভিন্ন পেশার সমাজের অবদান তুলে ধর।
উত্তরঃ ভূমিকা: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি ও বিশ্বের বিভিন্ন পেশার নাগরিকরা আন্তর্জাতিক প্রচারের ক্ষেত্রে, অর্থসংগ্রহ ও বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহদানের কাজে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত বাঙালি এবং অন্যান্য নাগরিকরা বাংলাদেশের জনগণের মতোই তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক ও শোষকের বিপক্ষে সংগ্রামে জড়িত ছিল। মূলত দেশের রাজনৈতিক মেরুকরণ ও আর্থসামাজিক অবস্থা বিদেশে অবস্থানরত বাঙালিদের মধ্যে সমভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যার প্রভাবে অন্যান্যরাও প্রভাবিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি ও বিশ্বের বিভিন্ন পেশার নাগরিকদের ভূমিকা: বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালি অথবা অন্যান্য দেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধে যে ভূমিকা রেখেছিল তা নিচে আলোচনা করা হলো:
১. ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা: ১৯৭১ সালের দিকে ব্রিটেনে যে সকল প্রবাসী বাঙালি বসবাস করতেন তাদেরকে মোটামুটি চার ভাগে ভাগ করা যায়। ১. ছাত্র: ২. শ্রমিক। ৩. ব্যবসায়ী; ৪. চাকরিজীবী সম্প্রদায়।
মুক্তিযুদ্ধকালে বিলেতে বসবাসকারী ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ব্রিটেনে প্রবাসী বাঙালি ছাত্রদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রকট ছিল। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে ব্রিটেনে প্রবাসী সকল স্তরের নাগরিকদের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল।
ব্রিটেনে অবস্থানরত শ্রমিক ও ব্যবসায়ী এবং চাকরিজীবীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের উপেক্ষা করে জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত করার বিষয়গুলো বাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
১৯৭১ সালে ব্রিটেনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে প্রচার কার্যে প্রবাসী ছাত্ররা বিশেষ অবদান রেখেছিল। ‘ইনার টেম্বল’ এ অধ্যয়নরত আইনের ছাত্র শামসুল আলম চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা সম্পর্কে অবহিত করেন। বাংলাদেশে পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবিতে বাঙালি ছাত্র শামসুদ্দিন ও তার সহকর্মী আফরোজ আফগান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটের নিকটবর্তী রাস্তার ফুটপাতে ২৫ মার্চ থেকে অনশন শুরু করেন। এছাড়াও প্রবাসীরা ব্রিটিশ সরকারকে স্মারকলিপি প্রদান, জনসমাবেশ ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ ও বাংলাদেশকে আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে প্রভূত অবদান রাখে। ব্রিটেনে অবস্থানরত প্রবাসীদের ভূমিকা নিচে আলোচনা করা হলো।
ক. কভেন্ট্রি সম্মেলন ও স্টিয়ারিং কমিটি: ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে লন্ডনসহ কয়েকটি বড় শহরে বহু সংগ্রাম পরিষদ আত্মপ্রকাশ করে। গাউস খানের নেতৃত্বে পরিচালিত যুক্তরাজ্যস্থ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লন্ডনে ‘কাউন্সিল ফর লিবারেশন অব বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এছাড়াও অন্যান্য দল আলাদা আলাদা কমিটি গঠন করে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পরামর্শক্রমে কভেন্টি নামক একটি ছোটো শহরে ইতোমধ্যে গড়ে উঠা সকল সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এক সম্মেলন আহ্বানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং এ সভায় পাঁচজন সদস্য বিশিষ্ট একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হয় এবং এর নামকরণ হয় ‘Stearing Committee of the Action Committee’.
খ. স্টিয়ারিং কমিটির বাংলাদেশ ফান্ড: মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার কার্য পরিচালনার পাশাপাশি অর্থসংগ্রহের জন্য এপ্রিল মাসে স্টিয়ারিং কমিটির এক সভায় বাংলাদেশ ফান্ড গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ ফান্ডের দুটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।
১. বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থসংগ্রহ ও সমন্বয়সাধন।
২. একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে খরচের ব্যবস্থা করা। এছাড়াও ব্রিটেনে অবস্থানরত প্রবাসীদের উদ্যোগে গড়ে উঠে বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ, বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটি, বাংলাদেশ নিউজলেটার প্রভৃতি। এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ব্রিটেনে তুলে ধরে বাংলাদেশভে সাহায্য করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায়।
২. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থাসরত প্রবাসীদের ভূমিকা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রবাসীরা নভেম্বরের দুর্যোগকে কেন্দ্র করেই সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করে আমেরিকার পাকিস্তান লীগ নামক প্রবাসীদের সংগঠন রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করে। ২৫ মার্চের ঘটনার পর নানা স্থানে তৎপরতা শুরু হয়। তাদের মূল কার্যক্রমের কেন্দ্রে ছিল মার্কিনিদের সরকারি অবস্থানের বিরোধিতা। এ সংগঠন তাদের নাম বাংলাদেশ লীগ এ রূপান্তর করে এবং প্রচার করে যে, এটা হচ্ছে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সাথে তুলনীয় এবং সবাইকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তানকে সাহায্য না করার জন্য অনুরোধ জানায়। মুজিবনগর সরকারের সাথেও এরা যোগাযোগ স্থাপন করে। কাজী এস. আহমেদ এর সভাপতি হন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান দূতাবাসের উপপ্রধান এনায়েত করিম ২৩ মার্চ তার বাড়িতেই অনুষ্ঠিত এক সভায় পাকিস্তানের বদলে বাংলাদেশের পতাকা তোলা হয় এবং এ অনুষ্ঠানেই এনায়েত করিমকে সভাপতি ও ডাঃ হারুন রশীদকে সম্পাদক করে একটি সমিতি গঠিত হয়।
২৮ মার্চ অনেকগুলো স্মারকলিপি বাংলাদেশের নাগরিকদের পক্ষ থেকে তারবার্তা করে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে পাঠানো হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য বেশ কতকগুলো সংগঠনও গড়ে তোলে। নিচে সেগুলো বর্ণনা করা হলো:
ক. বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ গঠন: মার্চ মাসের দিকে ‘বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ’ গঠিত হয় শিকাগো শহরে। এ সংগঠন তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে ঘোষণা দেয়। তাদের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে ছিল আমেরিকার জনগণকে বাংলাদেশের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অবহিতকরণ, বাঙালিদের সহায়তা করা, আমেরিকান সরকারের পাকিস্তান সম্পর্কে গৃহীত নীতির পরিবর্তন করানো ইত্যাদি এবং আমেরিকা প্রবাসী বাঙালিদের আত্মীয়স্বজন যারা পাকসেনাদের হাতে প্রাণ দিয়েছে, তাদের পাশে দাঁড়ানো ও প্রয়োজনীয় সহায়তা করা।
খ. বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা ওয়াশিংটন: বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা ওয়াশিংটন নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয় এবং এ সংগঠনের পক্ষ থেকে কংগ্রেস সদস্যদের প্রতি আকুল আবেদন জানানো হয় যে, তাদের সরকার যেন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক সমর্থন ও পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ করে।
গ. বাংলাদেশ সংগ্রামী ছাত্র সংস্থা: ১৪ মে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এর নাম দেওয়া হয় ‘বাংলাদেশ সংগ্রামী ছাত্র সংস্থা’। এ সংস্থা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমেরিকান নাগরিকদের বাংলাদেশি প্রবাসীদের সহানুভূতির জন্য আবেদন করে। এছাড়াও বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বসবাসরত বাঙালি ছাত্র বা চাকরিজীবীদেরকে সহযোগিতার জন্য আবেদন জানায়। এছাড়াও গড়ে উঠে নিউইয়র্কে প্রবাসী বাঙালি সমাজ প্রভৃতি সংগঠন। এছাড়া জর্জ হ্যারিসনের কনসার্টও উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা।
৩. কূটনীতিকদের তৎপরতা : বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার সাথে সাথে যেভাবে আপামর জনতা অংশগ্রহণ করেছিল ঠিক একইভাবে যোগ দেন বাঙালি কূটনীতিকরা। তারা বিভিন্ন দেশে ও সংস্থায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার ঘটনাগুলো তুলে ধরে বাংলাদেশকে সমর্থন ও আর্থিকভাবে সাহায্যের জন্য প্রচেষ্টা চালায়। তৎকালীন কূটনীতিক ও আমলাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন: এ. এইচ. মাহমুদ আলী, আবুল মাল আবদুল মুহিত, আব্দুর রাজ্জাক খান, অধ্যাপক রেহমান সোবহান প্রমুখ। এছাড়াও কানাডা, সুইডেন, ফ্রান্স, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, জাপানে বাঙালি সমাজ, জাকার্তাস্থ বাঙালি সমাজ, কাবুল, সৌদি আরব প্রভৃতি দেশের প্রবাসীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। সর্বোপরি ভারত বাংলাদেশকে অকুণ্ঠ সমর্থন ও সাহায্য করেছিল।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী ব্যঙালি ও বিদেশি নাগরিকরা যে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিল তা ভুলবার নয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী বাঙালি ও কিছু দরদি বিদেশি নাগরিকের সহায়তায় বিদেশে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে উঠে এবং তারা বিভিন্নভাবে বাংলাদেশকে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিল।