অথবা, মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি নাগরিক সমাজের প্রভাব বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি নাগরিক সমাজের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। বিদেশি নাগরিক সমাজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করে। পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যায়, অবিচার, গণহত্যার চিত্র বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয়। অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও সহানুভূতির দ্বারা তাড়িত হয়ে বিশ্ব জনমত গঠনে সহায়ক শক্তি হিসেবে বিদেশি নাগরিক সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিদেশি নাগরিকদের সহায়তা ও সমর্থন বৃহৎ শক্তির দেশসমূহের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি নাগরিক সমাজের ভূমিকা: মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি নাগরিক সমাজ বিশ্ব জনমত গঠন, অর্থ সহায়তা প্রদান, সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি, যুদ্ধে নৈতিক সমর্থন দানসহ মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। নিচে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা করা হলো:
১. মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি: বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিক সমাজ মুক্তিযুদ্ধে অতুলনীয় ভূমিকা পালন করে। সাধারণ জনগণ, রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে কিন্তু সেদেশের জনগণ, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। ১৪ এপ্রিল ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা জুড়ে ইয়াহিয়াকে গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানায়। সেপ্টেম্বর মাসে নয়া দিল্লিতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়, সেখানে ৩৩টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেয়। সেখানে ৭০ বছর বয়সী ফরাসি সাহিত্যিক আদ্রে মারলো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, ফ্রান্স, রাশিয়া প্রভৃতি দেশের নাগরিক সমাজ মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন প্রদান ও নিজ নিজ দেশের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল যে বিভিন্ন বৃহৎ শক্তি ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নাগরিক সমাজের কারণে যুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেয়নি। যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা সর্বদা বাঙালিদের সাথে রাস্তায় থেকেছে। ভারতের নাগরিক সমাজের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের সরকার এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সাংবাদিকসহ নাগরিক সমাজ মুক্তিযুদ্ধে অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদান করেছিল। কবি অ্যালাল জিন্সবার্গ সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড নামক কবিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের গণহত্যার চিত্র তুলে ধরে বিশ্ব জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
২. অর্থসংগ্রহ ও সহায়তা প্রদান: বিদেশি নাগরিক সমাজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সহায়তার জন্য অর্থসংগ্রহ শুরু করেন। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ ছিল মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বিদেশি নাগরিক সমাজের আয়োজন। পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খান এবং জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক অবিস্মরণীয় সংগীত সন্ধ্যা নিউইয়র্ক ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়। বব ডিলান, বিঙ্গো স্টা, বিলি পেস্টল, লিডন রাসেল, এরিখ ক্লাপটনসহ ৭৫ জন বিদেশি শিল্পী এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। উদ্যোক্তরা ২৪, ৩৪, ১৮৫ মার্কিন ডলার সংগ্রহ করে বাংলাদেশের তহবিলে দান করেন। অর্থের পাশাপাশি বাংলাদেশ নামটি রাতারাতি সবার কাছে পরিচিত হয়ে যায়। ইউরোপের শিশুরা তাদের খাবারের পয়সা বাঁচিয়ে সাহায্য করেছিল শরণার্থীদের।
৩. সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার: বৃহৎ শক্তির মধ্যে চীন ও মার্কিন সরকার পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক সমাজ ও বেশকিছু সিনেটর মার্কিন সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল যার ফলে শেষ পর্যন্ত মার্কিন সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নমনীয় নীতি গ্রহণ করে এবং শেষ পর্যন্ত সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। মার্কিন কংগ্রেস, সুশীল সমাজ ও প্রচারমাধ্যমের সতর্কতা এবং প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ চাপে নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন পাকিস্তানকে যতটা সমর্থন সহযোগিতা করতে চেয়েছিল ঠিক ততটা করতে সক্ষম হয়নি। জার্মানির এক গ্রামের জনতা ৩০,০০০ হাজার মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য। ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা প্রভৃতি দেশের নাগরিক সমাজ সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল।
৪. মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নৈতিক সমর্থন প্রদান: বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি নাগরিক সমাজ নৈতিক সমর্থন
প্রদান করেছিল। বুয়েযার্সের নোবেল জয়ী লেখক বোহেস, রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য আর্জেন্টিনার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো বাংলাদেশের পক্ষে নৈতিক সমর্থন প্রদান করে মিছিল করেছিল। জাপানের এক নাগরিক চাকরি ছেড়ে গাড়ি করে সারা দেশে ঘুরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার প্রচারণা চালিয়েছিল। প্যারিসের এক যুবক পাকিস্তানি বিমান ছিনতাই করেছিল, সেখানে ছিল ঔষধপত্র। তার দাবি ছিল ঔষধপত্র বাঙালি শরণার্থীদের দিতে হবে। ভারতের নাগরিক সমাজ এবং পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিজোরাম, আসাম, মেঘালয় প্রভৃতি রাজ্যের সর্বস্তরের জনগণ সর্বতোভাবে অর্থ, খাদ্য, আশ্রয়, বাসস্থান দিয়ে বাঙালি শরণার্থীদের সাহায্য করেছিল।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি নাগরিক সমাজের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। তাদের সর্বতো সমর্থন ও সহযোগিতার ফলে যে জনমত গড়ে উঠেছিল তা যুক্তিযোদ্ধাদের সর্বতোভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রকে ১২তম সেক্টর যদি বলা হয়, তাহলে বিদেশি নাগরিক সমাজ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ১৩নং সেক্টর। কাজেই মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি নাগরিক সমাজের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।