মুসলিম দর্শনে আল-কিন্দির অবদান সংক্ষেপে বর্ণনা কর।

অথবা, আল-কিন্দির দর্শনতত্ত্ব আলোচনা কর।

অথবা, আল-কিন্দির দর্শনতত্ত্ব ব্যাখ্যা কর।

অথবা, মুসলিম দর্শনে আল কিন্দির অবদান সম্পর্কে যা জান লেখ।

অথবা, আল-কিন্দির দর্শনতত্ত্ব বিশ্লেষণ কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে যে কয়েকজন খ্যাতনামা দার্শনিক অসামান্য অবদান রেখে চির স্মরণীয় হয়ে আছেন আল-কিন্দি তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি সক্ষিণ আরবের কুফা নগরীর কিন্দা গোত্রে ৮১৩ সাপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রখর মেধা ও চিন্তাশক্তির অধিকারী ছিলেন। আরবদের মধ্যে তিনিই প্রথম প্রধাগত দশন চর্চাত সূত্রপাত করেন। মূলত বুদ্ধিবাদী মুতাজিলা সম্প্রদায়ের পরে যে ফালাসিফা সম্প্রদায় আত্মপ্রকাশ করে। আল কিন্দি ছিলেন তাদের আনায়ক। মুসলিম দর্শনের সমৃদ্ধি অর্জনে তাঁর দর্শন চিন্তা মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।

দর্শনে আল-কিন্দির অবদান: আল-কিন্দি মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে প্রথম চিন্তাবিদ, যিনি ধর্মতত্ত্বকে ছাড়িয়ে জগৎ ও জীবনের মৌলিক সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। আর তাই মুসলিম চিন্তাধারায় তার অবদান অনস্বীকার্য। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচিত হলো:

Five Essence: আল-কিন্দি মুসলিম চিন্তাধারায় প্রথম অধিবিদ্যক চিন্তাধারার সূচনা করেন। তাঁর মতে, ৫টি মৌলিক উপাদান-জড়, আকার, গতি, কাল ও দেশ বস্তুজগৎকে নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি এ সম্পর্কে তাঁর On the five Essnce’ গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। যথা:

ক. জড়: জড় এমন এক দ্রব্য, যার আশ্রয় করে গুণাবলি অবস্থান করে। জড়ের মধ্যে আমরা গুণকে পাই, কিন্তু গুেেণর মধ্যে জড়কে পাই না। যতদিন জড় থাকবে তত দিন তার গুণাবলিও থাকবে। আর তাই জড়ের অস্তিত্ব ছাড়া গুণতে কল্পনা করা যায় না।

খ. আকার: আল-কিন্দির মতে, আকার দু’রকমের। প্রথমত, আকার হলো জড়ের একটি অবিচ্ছেদ্য গুণ। সেগুলো হলো দ্রব্য, পরিমাণ, গুণ, সম্বন্ধ, দেশ, কাল, অবস্থান, শর্ত, ক্রিয়া ও অনুরাগ। দ্বিতীয়ত, আকার বলতে এমন শক্তি বুঝায়, যার বলে আকারহীন জড় হতে বস্তু উৎপন্ন হয়।

গ. গতি: আল-কিন্দি গতিকে ৬ প্রকার বলেছেন। সেগুলো হলো গুণগত, স্থানগত, উপাদানগত, বিলোপকারী, বৃদ্ধি এবং হ্রাস গতি।

ঘ. কাল বা সময়: কাল ও গতি একই ধরনের বলে আল-কিন্দি মত প্রকাশ করেন। কিন্তু কাল সবসময় একদিকে বা সামনের দিকে ধাবিত হয়, পূর্বাপর সম্পর্কের মাধ্যমেই আমরা কালকে জানতে পারি।

ঙ. দেশ: দেশের মধ্যেই বস্তু অবস্থান করে। আল-কিন্দি দেশ বা স্থান বলতে সাধারণত আকার বিশিষ্ট দ্রব্যের বহির্বিভাগকে বুঝিয়েছেন। দেশ দ্রব্যকে বেষ্টন করে, তবে দ্রব্যকে সরিয়ে দিলেও দেশের অবস্থান থাকে।

ধর্ম ও দর্শন: আল-কিন্দি ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে সমন্বয়ে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তার মতে, পরম সত্তার জ্ঞান লাতে প্রজ্ঞা ও প্রত্যাদেশ উভয়েরই গুরুত্ব সমান। শুধু তাই নয়, এদের যে কোন একটিকে একমাত্র পথ বলা খুবই দুভার্গ্যজনক। তার মতে, মূলত ধর্ম ও দর্শন একই সত্তাকে নির্দেশ করে।

আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা: আল-কিন্দি তাঁর গ্রন্থ AL-Sinaat-alujma তে আল্লাহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ গ্রন্থে তিনি বলেছেন, আল্লাহর জন্য সর্ববিধ প্রশংসা, তিনি প্রজ্ঞা ও গতির অধিকর্তা, চিরন্তন হওয়ার কারণে তিনি অদৃশ্য, গতিহীন তবে সবগতির কারণ।

বিশ্বতত্ত্ব: আল-কিন্দির মতে, বিশ্বজগৎ নিয়ন্ত্রণমূলক সমগ্র বিশেষ। পৃথিবীতে যা ঘটে তা পূর্বাপর কার্যকারণ সম্পর্কে সম্পর্কিত। কারণসমূহ উচ্চতর বা নিম্নতর হতে পারে। তাই এ মত Theory of Emanation’ কে স্মরণ করিয়ে দেয়। নিম্নতর কারণসমূহ উচ্চতর কারণসমূহের ফলশ্রুতি। সব অস্তিত্ব নিম্নতর অস্তিত্বকে প্রভাবিত করে।

কার্যকারণ সম্পর্ক: আল-কিন্দি জগতের সব বিষয় ও বস্তু এবং ঘটনাবলিকে কার্যকারণ সম্পর্কের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, জাগতিক ঘটনাবলির মধ্যে রয়েছে একটি কার্য ও কারণের সম্পর্ক। এ সুশৃঙ্খল জগতের পিছনে এমন একটি আদিকারণ রয়েছে যা সর্বোচ্চ। আল্লাহ এ আদিকারণ অর্থাৎ, তিনি সব কারণের কারণ তবে তার আর কোন কারণ নেই। কতকগুলো সূত্র বা নিয়মের মাধ্যমে তিনি জগৎকে পরিচালনা করেন। তবে কার্য ও কারণের একটি ক্রম রয়েছে। অর্থাৎ, কারণ পূর্বে সংঘটিত হয় এবং পরে আসে কার্য। এ মতানুযায়ী নিম্নস্তরের কারণ উচ্চস্তরের, কারণের ফল।

মানবাত্মা: আল-কিন্দির অধিবিদ্যক আলোচনায় মানবাত্মা সম্পর্কিত আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্লেটোর মত জড় ও আত্মাকে দু’টি পৃথক সত্তা বলেছেন। আত্মা জড়ের চেয়ে শুধু স্বতন্ত্রই নয়, উচ্চতরও বটে। জড়ের কাজ আত্মার নির্দেশ মেনে চলা। তিনি বিশ্ব আত্মার কথা বলেছেন, যেটির অবস্থান জড় ও আল্লাহর মধ্যবর্তী। মৃত্যুতে আত্মা দেহ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সে আত্মা জগতে ফিরে আসে।

নির্গমন মতবাদ বা Theory of Emanation: জগৎ সৃষ্টির প্রক্রিয়া সম্পর্কে আল-কিন্দি এক বিশেষ মতবাদের অবতারণা করেন। এটির দ্বারা তার উপর গ্রিক প্রভাব সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। তার মতে, জগৎ খোদা হতে বিনির্গত হয়েছে অসেচতনভাবে। ঠিক যেমন সূর্যরশ্মি সূর্য হতে নির্গত হয়। তার মতে, জগৎ সরাসরি আল্লাহ হতে নির্গত হয় নি, কতকগুলো বিশেষ মধ্যবর্তী আধ্যাত্মিক মাধ্যমের ভিতর দিয়ে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আল-কিন্দি প্রথম দার্শনিক, যিনি কুরআন ও হাদিসের আলোকে দার্শনিক আলোচনাকে একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে আসতে সক্ষম ছিলেন। তার যুক্তিবিজ্ঞান এবং গণিতের প্রতি গুরুত্ব প্রদান ধর্মতাত্ত্বিক তথা অপরাপর চিন্তাবিদদের নতুন দিকনির্দেশনা প্রদান করে। তিনি নব্য প্লেটোবাদীদের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত, তবে কুরআনের ও হাদিসের আলোকে এর ব্যাখ্যাটি সত্যিই অভিনব। আর এদিক দিয়ে বিচার করলে আল-কিন্দির অবদান (মুসলিম দর্শনে) অনস্বীকার্য।