অথবা, ইবনে সিনার দর্শন আলোচনা কর। মুসলিম দর্শনে তাঁর গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, মুসলিম দর্শনে ইবনে সিনার অবদান বিস্তারিত বিশ্লেষণ কর। অথবা, মুসলিম দর্শনে ইবনে সিনার অবদান সম্পর্কে যা জানা বিস্তারিত লেখ।
অথবা, মুসলিম দর্শনে ইবনে সিনার অবদান বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: মুসলিম জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রি.) তাঁর মনের গভীরতা, চিন্তাশক্তির প্রখরতা ও বিশ্বজনীন উদার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বিশ্বের সুধী সমাজে বিশেষভাবে সুপরিচিত। তিনি এরিস্টটলের দর্শনের একজন সফল ভাষ্যকার। মুসলিম দর্শনে আল-ফারাবি যে নব্য প্লেটোবাদী ঐতিহ্যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সে ঐতিহ্যের প্রাচ্যদেশীয় শ্রেষ্ঠতম প্রবক্তা ও ব্যাখ্যাকারী ছিলেন ইবনে সিনা। গ্রিক দর্শন বিশেষ করে এরিস্টটলের সর্শন অধ্যয়ন ও অনুশীলনে তিনি ছিলেন ফারাবির চেয়ে অনেক বেশি সংঘবদ্ধ ও প্রাঞ্জল। সমসাময়িক এমনকি পরবর্তীকালে পাঠক ও বিদগ্ধ সমাজে তাঁর মতাবলি সমর্থিত হয়েছিল বর্ণনার স্বতঃস্ফূর্ত এবং রচনার গুণগতমানের উৎকৃষ্টতার জন্য।
ইবনে সিনার দর্শন: ইবনে সিনা ছিলেন মুসলিম চিন্তাবিদগণের মধ্যে অন্যতম, তাঁর মতে, দর্শন ও ধর্ম সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বিশ্বাস ও বুদ্ধির সমন্বয় সাধন করা দর্শনের কাজ নয়, বরং প্রজ্ঞার সাহায্য জীবন ও জগতের সমস্যাবলির ব্যাখ্যা দান করাই দর্শনের মূল লক্ষ্য। তার মতে, দর্শন হলো সর্বজনীন আনানুশীলন। শুধু তাই নয়, সমগ্র বিজ্ঞানও দর্শনের অন্ত র্ভুক্ত। তিনি আরও বলেছেন, অভিজ্ঞতাভিত্তিক বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমেও জ্ঞান লাভ করা যায় সত্য, কিন্তু সে জান দর্শনের মত পূর্ণাঙ্গ আন নয়। পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ জ্ঞান একমাত্র দর্শন চর্চার মাধ্যমে পাওয়া যায়। ইবনে সিনার দার্শনিক মতবাদসমূহ
১. যুক্তিবিদ্যা: ইবনে সিনার যুক্তিবিদ্যা আলোচনা করলে দেখা যায় যে, তিনি আল-ফারাবি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। দার্শনিক হিসেবে তিনি সত্যানুসন্ধানী। তাঁর মতে, দার্শনিক অনুসন্ধানের হবে যুক্তিবিদ্যা দিয়ে। তাঁর মতে, যুক্তিবিদ্যা হলো চিন্তামূলক শিল্প। ‘আল নাযাত’ শিরোনামে তাঁর রচনায় আমরা যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে আলোচনার সাক্ষাৎ পাই। এছাড়া ‘আর ইশারাত’ নামক অন্য একটি গ্রন্থে উল্লেখযোগ্যভাবে যুক্তিবিদ্যার আলোচনা পরিলক্ষিত হয়। যুক্তিবিদ্যা আলোচনা করে চিন্তার আকার নিয়ে। যুক্তিবিদ্যার আরেকটি অন্যতম কাজ হলো সংজ্ঞা নিরূপণ। তাঁর মতে, সংজ্ঞা সব সুষ্ঠু চিন্তার ভিত্তিস্বরূপ। তিনি এরিস্টটলের মত প্রতিটি বচনের দু’টি ভাগ যা উদ্দেশ্য ও বিধেয়ের কথা বলেছেন। তিনি সহানুমানের কথা বলেছেন। তাঁর মতে, সহানুমান হলো এমন একটি পদ্ধতি যে কোন দু’টি সত্যের ভিত্তিতে তৃতীয় কোন সত্যকে অনুমান করা হয়। তিনি যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের কথা বলেছেন, তা হলো তিনি মনে করেন যে, যুক্তিবিদ্যা বিজ্ঞান ও গণিতের চেয়ে উচ্চতর।
২. মনোবিদ্যা: ইবনে সিনা দেহ ও আত্মার দ্বৈতবাদের কথা বলেছেন আত্মা স্বতন্ত্র এবং এটি দেহ হতে সম্পূর্ণ পৃথক সত্তা। আকস্মিকভাবে আত্মা মানবদেহের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। আর তাই এটি দেহের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়। প্রতিটি আত্মা বিশ্বআত্মা হতে এসেছে। আত্মা একটি বিশেষ বা স্বতন্ত্র দ্রব্য। আত্মাকে ইবনে সিনা তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা: ১. উদ্ভিদ আত্মা ২. জীবাত্মা ৩. মানবাত্মা। উদ্ভিদ আত্মার তিনটি বৃত্তি হলো বর্ধন শক্তি, বিকাশ শক্তি ও পুনরুৎপাদন শক্তি। জীবাত্মার রয়েছে প্রধানত দু’টি বৃত্তি। প্রথমটি হলো সঞ্চালন শক্তি। এর আরও দু’টি দিক ক্ষুন্নিবৃত্তি ও ক্রিয়াকর্ম রয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো প্রত্যক্ষণ শক্তি, যার দু’টি দিক রয়েছে বহিঃইন্দ্রিয় ও আন্তঃইন্দ্রিয়। বহিঃইন্দ্রিয় হলো দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, স্বাদ, ঘ্রাণ। আর আন্তঃইন্দ্রিয়গুলো হলো সাধারণ বুদ্ধি, কল্পনা, চিন্তামূলক শক্তি, মূল্য নির্ধারক শক্তি ও স্মৃতি। ইবনে সিনা তৃতীয় যে আত্মার কথা বলেছেন তা হলো মানবাত্মা। মানবাত্মার দু’টি দিক রয়েছে। যথা: প্রথমটি হলো বিশুদ্ধ বুদ্ধি, যা মূর্ত চিন্তা করে, আর দ্বিতীয়টি হলো ব্যবহারিক বুদ্ধি, যা দৈহিক মানদণ্ড সম্পর্কে আলোচনা করে।
৩. অধিবিদ্যা: ইবনে সিনা আধ্যাত্মিক শক্তিকে পার্থিব শক্তির উর্ধ্বে উন্নীত করেছিলেন। তাঁর মতে, খোদা শ্রেষ্ঠতম আধ্যাত্মিক সত্তা। তিনি সমস্ত জড়শক্তির উর্ধ্বে। আত্মা জড় ও আধ্যাত্মিক শক্তির মধ্যে বিদ্যমান দূরত্বকে লাঘব করে। আত্মার দ্বারা আধ্যাত্মিক ও জড়াতত্মক উভয় শক্তির সমন্বয় সাধিত হয়েছে। সত্তার আলোচনায় ইবনে সিনা দু’ধরনের সত্তা সম্ভাব্য ও নিশ্চয়াত্মক সত্তার কথা বলেছেন। সম্ভাব্য সত্তা নিশ্চয়াত্মক সত্তার উপর নির্ভরশীল। নিশ্চয়াত্মক সত্তা কারও উপর নির্ভরশীল নয়। সে নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। ইবনে সিনা সত্তার মত অস্তিত্বকেও দু’ধরনের বলে অভিহিত করেন। সেগুলো হলো সম্ভাব্য অস্তিত্ব ও অনিবার্য অস্তিত্ব। অনিবার্য সত্তা এক ও অদ্বিতীয়। অর্থাৎ, এর মধ্যে বহুত্ব নেই। তাই যদি হয়, তাহলে বহুত্বের ব্যাখ্যা কি হতে পারে? এ প্রসঙ্গে ইবনে সিনার মত হলো বিশ্বআত্মার ধারণার মধ্যেই আছে বহুত্বের ধারণা। এ বিশ্বআত্মা বা World soul হতেই বৈচিত্র্য বা বহুত্বের উদ্ভব হয়েছে। ইবনে সিনা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন। যে কোন সত্তার অস্তিত্ব লাভ করে আল্লাহর ইচ্ছার মাধ্যমে।
উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একথা বলা যায় যে, ইবনে সিনা ছিলেন একাধারে দার্শনিক, চিকিৎসাবিদ, দার্শনিক কবি। তার জীবন ছিল বৈচিত্রময় ঘটনাবলির সমষ্টি। অল্প বয়সে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তিমূলক জ্ঞান অর্জন করেন। তাছাড়া আরব সভ্যতায় প্রাচীন গ্রিক জ্ঞানবিজ্ঞান ও দর্শনকে যথার্থভাবে সঞ্চালন করেন। এক্ষেত্রে তার অবদান অতুলনীয়। তিনিই প্রথম ইউক্লিডীয় জামিতিকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি জড়বাদ ও বাস্তববাদের সমন্বয় সাধন করেন। তিনি শুধু যুগের চিন্তাধারার অগ্রদূত ছিলেন না। তিনি ছিলেন কালজয়ী চিন্তা নায়ক। তাই দর্শনে তার অবদান অনস্বীকার্য।