অথবা, ম্যাকিয়াভেলির নবজাগরণ বলতে কী বুঝ?
অথবা, নবজাগরণ সম্পর্কে ম্যাকিয়াভেলির দৃষ্টিভলি সংক্ষেপে লিখ।
অথবা, ম্যাকিয়াভেলির পুনর্জন্মের সংজ্ঞা দাও।
অথবা, নবজাগরণ বলতে ম্যাকিয়াভেলি কী বুঝাতে চেয়েছিলেন?
উত্তরঃ ভূমিকা: মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে ম্যাকিয়াভেলি একটা অনন্য দৃষ্টান্ত। মধ্যযুগের গণজাগরনে তিনিই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ধর্ম ও নৈতিকতাকে রাজনীতি থেকে পৃথক করে মধ্যযুগের রাজনৈতিক চেতনায় একটা গণজাগরণ তৈরি করেন।
মেকিয়াভেলির নব জাগরণ: ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা বুঝতে হলে কেবল ম্যাকিয়াভেলি পূর্ব ইতালির রাজনীতি ও সমাজচিত্র জানলে চলবে না, এর সাথে প্রয়োজন ইতালি তথা ইউরোপের নবজাগরণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করা। কারণ ম্যাকিয়াভেলিকে নবজাগরণের সন্তান বলে অভিহিত করা হয়। নবজাগরণ বা রেনেসাঁর ফলে গোটা ইতালির সমাজে যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল, তার পরেই তিনি রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে আলোচনা করে গেছেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে নবজাগরণের প্রথম সূত্রপাত ঘটে ইতালিতে। কিন্তু কোন একটা নবজাগরণ ইতালির সমগ্র সমাজ জীবনকে প্লাবিত করেছিল। নবজাগরণের ফলে মানুষ তার নিজের অস্তিত্ব ও গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন ও প্রত্যয়সম্পন্ন হয়ে উঠে। পরলোক বিষয়ে চিন্তাভাবনা ত্যাগ করে ইহলোকের সুখস্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে সে নিজেকে ব্যাপৃত করে ফেলে। মানুষের যুক্তিবাদিতা, অনুসন্ধিৎসা, অজানাকে জানার আগ্রহ বেড়ে যায়। সমগ্র বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষ পরিণত হয়। নবজাগরণের নানা কেন্দ্রের মধ্যে ইতালির ফ্লোরেন্স শহর অন্যান্য জায়গা থেকে
এগিয়ে যায়। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (Leonardo De Vinci) নবজাগরণের যুগেই জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ফ্লোরেন্সের নাগরিক। এছাড়া ফ্লোরেন্স শহর অন্যান্য বিষয়ে সৃজনশীল কাজকর্মে সাফল্য দেখায়। সার্বিক নবজাগরণের প্রভাব ম্যাকিয়াভেলির চিন্তাধারাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। নবজাগরণ যেমন মানুষকে যুক্তিবাদি করেছিল, তেমনি ম্যাকিয়াভেলিও কোন বিষয়কে যুক্তি ও অভিজ্ঞতার মাপকাঠিতে বিচার না করে গ্রহণ করেন নি। প্লেটো ও এরিস্টটল এর মতো ম্যাকিয়াভেলি আদৌ দার্শনিক ছিলেন না। তাঁর যাবতীয় চিন্তার ভিত্তি ছিল অভিজ্ঞতা ও যুক্তি। সমাজের মানুষকে তিনি যেমনটি দেখেছিলেন, তারই ভিত্তিতে তিনি আলোচনা করে গেছেন। ব্যক্তির কি হওয়া উচিত ছিল তা ম্যাকিয়াভেলির আলোচনায় স্থানলাভ করে নি। মানুষ কি এবং সে কি করে, কেমন আচরণ দেখায়, এটাই তাঁর আলোচনার মূখ্য বিষয়। মানুষের আচরণ নবজাগরণের ফলে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। সে পরিবর্তন শেষ পর্যন্ত ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হয়। মধ্যযুগে মানুষ ধর্মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল। নবজাগরণ এসে সে শৃঙ্খল ছিন্ন করে দেয় এবং এ বিচ্ছিন্নতার সূত্র ধরে ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রচিন্তার কাঠামো নির্মাণে অগ্রসর হন। নবজাগরণের ফলে যে জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছিল, সেটাই ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রচিভার উপজীব্য বিষয়ে পরিণতি লাভ করে। দর্শন চিন্তার চেয়ে তিনি সমাজের বিকাশকে প্রধান বলে বিবেচনা করতে আরম্ভ করেন। এ বিকাশের জন্য প্রয়োজন একটা শক্তিশালী স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতীয় রাষ্ট্র। গ্রিক দার্শনিকদের আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা বাস্তবতার চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে নি। নবজাগরণ দর্শনকে অস্বীকার করে নি। কিন্তু প্রয়োজনে ব্যক্তি, রাষ্ট্র শাসন ইত্যাদি অগ্রাধিকার পাবে। তাই আমরা ম্যাকিয়াভেলির মধ্যে এগুলোর প্রাধান্য দেখতে পাই।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ম্যাকিয়াভেলি নবজাগরণের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেখানে তিনি নিজেকে নতুনভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। মধ্যযুগে ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে যে নব জাগরণ এনে দিয়েছেন তার উপর ভিত্তি করে মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার প্রসার ঘটেছে। আর এ জন্যই তাকে মধ্যযুগের নবজাগরণের স্রষ্টা বলা হয়।