যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক প্রবণতা আলোচনা কর।

অথবা, যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক প্রবণতা কী?

অথবা, যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক প্রবণতাসমূহ কী কী?

উত্তর: ভূমিকা: বিশ্বের সকল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সাম্প্রতিককালে একটি সাধারণ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আর তা হল কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতার অত্যধিক প্রসার ও বৃদ্ধি। সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে মৌল ধারণা হল যে, কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলোর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য থাকবে এবং উভয় ধরনের সরকারই স্ব-স্ব স্বাতন্ত্র্য রেখে স্বাধীনভাবে কাজ করবে। কিন্তু বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামো ও কার্যগত ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশের কেন্দ্রীয় সরকার অত্যধিক পরিমাণে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই রাজ্য সরকারগুলোর স্বাতন্ত্র্য ও অস্তিত্ব বহুলাংশে ক্ষুন্ন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ সাম্প্রতিক গতিকে কেন্দ্রীয় প্রবণতা হিসেবে অভিহিত করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক প্রবণতা: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কে. সি. হুয়ার (K. C. Wheare) এ প্রসঙ্গে যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট, সমাজ সেবামূলক কাজের বিস্তার এবং পরিবহন ও শিল্পের ক্ষেত্রে যান্ত্রিক বিপ্লবকেই কেন্দ্র প্রবণতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নিম্নে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক প্রবণতার কারণগুলো আলোচনা করা হলো:

১. যুদ্ধ ও যুদ্ধের ভীতি: আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় প্রবণতার প্রথম এবং প্রধান কারণ হল যুদ্ধ ও যুদ্ধের ভয়ভীতি। আধুনিক কালের যুদ্ধ হল সর্বাত্মক যুদ্ধ। এ যুদ্ধ পরিচালনার জন্য দেশের যাবতীয় শক্তি ও সম্পদকে দ্রুতগতিতে একত্রিত করে তা যুদ্ধকার্যে নিয়োজিত করতে হয়, যা একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। সে জন্য প্রায় সকল যুক্তরাষ্ট্রেই দেশের প্রতিরক্ষার দায়দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি অপরিহার্যভাবে বেড়ে যায়।

২. অঙ্গরাজ্যের অসাম্য: অঙ্গরাজ্যগুলোর অসম উন্নয়ন কেন্দ্রীয় প্রবণতার একটি অন্যতম কারণ। ত্রুটিপূর্ণ অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কারণে পশ্চাৎপদ অঙ্গরাজ্যগুলোর পক্ষে সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে পরিচালনা তথা বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট জনগণের দাবি বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষিতে অনুন্নত অঞ্চলগুলোতে ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করে তাদের সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করে এবং এর সাথে সাথে অঙ্গরাজ্যের ক্রিয়াকলাপের উপর হস্তক্ষেপ চলে আসে।

৩. আর্থিক সংকট: যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় প্রবণতার একটি বিশিষ্ট দিক হল আর্থিক সংকট। বর্তমানে জনগণের মধ্যে ব্যাপক দারিদ্র্য, বেকারত্ব, দুর্ভিক্ষ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আর্থিক মন্দা প্রভৃতি অর্থনৈতিক সংকট রাজ্যগুলোর সীমিত অর্থনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এ অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশকে মুক্ত করার দায়িত্ব স্বভাবতই কেন্দ্রীয় সরকারের উপর ন্যস্ত হয়। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠে।

৪. দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার অধীনে অধিবাসীদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আঞ্চলিক সরকারের পরিবর্তে জাতীয় সরকারের প্রতি আনুগত্য বৃদ্ধি পেয়েছে জনজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাদির সমাধানের ব্যাপারে জনগণ রাজ্যের সীমিত সঙ্গতির পরিবর্তে জাতীয় সরকারের উপর অত্যধিক নির্ভরশীল হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৫. সমাজ সেবামূলক কার্যাবলির প্রসার: আধুনিক রাষ্ট্র জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। সময়ের বিবর্তনে জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসার ও সরকারের প্রতি জনগণের দাবিদাওয়া বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারকে বহুমুখী জনকল্যাণকর দায়িত্ব পালন করতে হয়। এসব কল্যাণকর কার্যের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও দক্ষতার প্রয়োজন তা রাজ্য সরকারগুলোর নেই। ফলে এসব দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারকে পালন করতে হয়, যা কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকাকে অপ্রতিহত করে তুলেছে।

৬. জরুরি অবস্থা: যুদ্ধ ছাড়াও যে কোন জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের চেয়ে ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার এদিক থেকে শক্তি বিস্তারে সক্ষম হচ্ছে।

৭. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা: অর্থনৈতিক পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় প্রবণতার একটি বিশেষ দিক। জনগণের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনের জন্য প্রয়োজন সুচিন্তিত ও সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। অর্থনৈতিক পরিকল্পনার উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়িত করার জন্য যে জিনিস সর্বাগ্রে প্রয়োজন সেটা হল অর্থ। আর এ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিতে হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৮. সংবিধান সংশোধন: সংবিধান সংশোধন সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় প্রবণতার একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। প্রত্যেক রাষ্ট্রেই কম বেশি সংবিধান সংশোধন হয়ে থাকে। আর এর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশোধনকালে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়। কেন্দ্রীয় সরকার এরূপ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে স্বীয় ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তোলে।

৯. কেন্দ্রীয় সরকারের সপক্ষে বিচার বিভাগের রায় দান: বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ কেন্দ্রীয় সরকারের অনুকূলে রায় দিয়ে কেন্দ্রের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হওয়ার ফলে সংবিধান সংশোধন ছাড়াই কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা সম্প্রসারিত হয়েছে। এরূপ পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে পুরাতন সংবিধানের সামঞ্জস্য বিধানের জন্য বিচারপতিরা কেন্দ্রীয় সরকারের সপক্ষে রায় দান করেন।

১০. শক্তিশালী সরকার: শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্রীয় প্রবণতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, প্রাদেশিক সরকারগুলোর তুলনায় কেন্দ্রীয় সরকার অত্যধিক শক্তিশালী। এরূপ শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে প্রাদেশিক সরকারসমূহের উপর কর্তৃত্ব করে থাকে। এসব পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের প্রভাব উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক কেন্দ্রীয় প্রবণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী Lipson এর সাথে সুর মিলিয়ে বলতে পারি যে, “আধুনিক সমাজের প্রধান প্রধান চালিকাশক্তিসমূহ ঐক্যবদ্ধভাবে কেন্দ্রাভিমুখে ধাবিত হচ্ছে আর এর ফলে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের মধ্যকার পার্থক্য দিনদিন অস্পষ্ট হয়ে উঠছে।”