যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রকৃতি উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: ক্ষমতার আঞ্চলিক ফণ্টনের ভিত্তিতে এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করা হয়। এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা একটিমাত্র মূল সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই ন্যস্ত বাজো দিত সরকার। কেন্দ্রীয়, সরকার সমগ্র দেশের সাধারণ স্বার্থসংক্রান্ত বিষয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করে। আর থাকে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় দু’ধরনের সরকার থাকে। একটি কেন্দ্রীয় সরকার এবং কতকগুলো প্রাদেশিক বা অদমণিরকারগুলোর উপর আঞ্চলিক স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে শাসনকার্য পরিচালনার দায়দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে। উভয় সরকার স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে এবং স্বাতন্ত্র্য ও ক্ষমতা ভোগ করে। উভয় ধরনের সরকারের পরিধি একটি লিখিত সংবিধানের মাধ্যমে নির্দিষ্ট থাকে। একে অপরের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করে না। দু’ধরনের সরকার, উভয় প্রকার সরকারের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন এবং স্বাতন্ত্র্যের সংবিধানগত স্বীকৃতি যুক্তরাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্য।

যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহ: যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থার অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিম্নে এগুলো আলোচনা করা হল:

১. দু’ধরনের সরকার: একটি কেন্দ্রীয় এবং কতকগুলো আঞ্চলিক সরকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় সরকার সমগ্র দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে বা জাতীয় বিষয়াবলি নিয়ে কাজ করে। আর আঞ্চলিক সরকারগুলোর উপর নিজ নিজ অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার ও আঞ্চলিক সরকারসমূহের সহাবস্থান বর্তমান থাকে।

২. ক্ষমতার কটন: আঞ্চলিক ক্ষমতার বণ্টন হল যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় সরকার এবং অঙ্গরাজ্যগুলোর সরকারসমূহের মধ্যে ক্ষমতা সংবিধানের দ্বারা বন্টিত হয়। ক্ষমতা এমনভাবে বষ্টিত হয় যে, কোন সরকার অপরের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সংবিধান নির্দিষ্ট ক্ষমতার পরিধির মধ্যে থেকে উভয় প্রকার সরকারই নিজ নিজ ক্ষেত্রে শাসনকার্য পরিচালনা করে।

৩. স্বায়ত্তশাসন: শাসনব্যবস্থায় প্রদেশগুলো স্ব-স্ব ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। কেন্দ্রীয় সরকার অহেতুক প্রাদেশিক সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে কেন্দ্রীয় সরকারের অহেতুক হস্তক্ষেপ কেন্দ্রীয় সরকারের ভিতকে দুর্বল করে দিতে পারে। তাই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হয়।

৪. দু’শ্রেণীর আইন: যুক্তরাষ্ট্রে দুশ্রেণীর আইন থাকে। যথ্য: ক. কেন্দ্রীয় আইন এবং খ, রাজ্য আইন। কেন্দ্রকে প্রদত্ত ক্ষমতার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় আইনসভা আইন প্রণয়ন করে। অপরদিকে, রাজ্যকে প্রদত্ত ক্ষমতার ভিত্তিতে রাজ্য আইনসভা আইন প্রণয়ন করে। নাগরিককে উভয় আইনই মান্য করে চলতে হয়।

৫. শাসনতন্ত্রের প্রাধান্য: যুক্তরাষ্ট্রে শাসনতন্ত্রের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার সকল ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ণ প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় বা আঞ্চলিক কোন সরকারই নয়, শাসনতন্ত্রের পূর্ণ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কারণ শাসনতন্ত্রই হল সকল ক্ষমতার একমাত্র উৎস। কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারসমূহের সকল ক্ষমতা সংবিধানেই সুনির্ধারিত থাকে।

৬. লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয় শাসনতন্ত্র: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্র লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয় হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় উভয় ধরনের সরকারের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষমতা বণ্টিত হয়। ক্ষমতার এ কটনব্যবস্থা সুস্পষ্টভাবে সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকে। আবার সংবিধানের নির্দিষ্ট ক্ষমতার বণ্টন ব্যবস্থাকে কোন সরকার যাতে এককভাবে পরিবর্তন করে নিজ ক্ষমতার সীমা বৃদ্ধি করতে না পারে তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের পরিবর্তন পদ্ধতি হয় জটিল।

৭. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত: যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত বা Federal Court যুক্তরাষ্ট্রের অপর এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সংবিধানের ব্যাখ্যা, কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক সরকারসমূহের মধ্যে সম্ভাব্য বিরোধের মীমাংসা প্রভৃতি দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালতের অস্তিত্ব প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সরকারগুলোর মধ্যে সংবিধানসম্মত ক্ষমতার ভারসাম্য এ সর্বোচ্চ আদালতই রক্ষা করে।

৮. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় আইনসভা: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় আইনসভা হয় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। কেন্দ্রীয়
আইনসভার মধ্যে নিম্নকক্ষটি গঠিত হয় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে। উচ্চকক্ষটি গঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনকারী অঙ্গরাজ্যগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে। উচ্চকক্ষে প্রতিনিধি প্রেরণের ব্যাপারে ক্ষুদ্র, বৃহৎ ও জনবহুল জনবিরল নির্বিশেষে অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে সমপ্রতিনিধিত্বের নীতি অনুসরণ করা হয়।

৯. দ্বৈত নাগরিকত্ব: Double citizenship বা দ্বৈত নাগরিকত্বও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সকল নাগরিক একাধারে সমগ্র দেশের নাগরিক এবং নিজ নিজ অঙ্গরাজ্যের নাগরিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ দ্বৈত নাগরিকত্বের নীতি স্বীকৃত। কিন্তু ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বীকৃত হয় নি।

১০. স্বতন্ত্র সংবিধান: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য একটি জাতীয় সংবিধান থাকে। তদনুসারে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত হয়। আবার রাজ্য সরকারগুলোর জন্য স্বতন্ত্র সংবিধানের সংস্থান থাকে। অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য এ সংবিধান প্রয়োজন হয়। তবে জাতীয় সংবিধানের মৌলিক নীতির সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে এ সংবিধান রচিত হওয়া বিধেয়।

১১. দ্বৈত বিচার ব্যবস্থা: দ্বৈত বিচার ব্যবস্থা হল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রের এবং রাজ্যের বিচারব্যবস্থা আলাদা। কেন্দ্রীয় আইনের জন্য কেন্দ্রের বিচার ব্যবস্থা এবং রাজ্যের আইনের জন্য অঙ্গরাজ্যের বিচার ব্যবস্থা থাকে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, উক্ত প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাতে প্রমাণিত হয় যে শাসনব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক ও জনমুখী করার ক্ষেত্রে এ সরকার ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই।