অথবা, আল-ফারাবির যুক্তিবিদ্যার অবদান সম্পর্কে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, যুক্তিবিদ্যায় আল-ফারাবির অবদান আলোচনা কর।
অথবা, যুক্তিবিদ্যায় আল-ফারাবির অবদান সম্পর্কে যা জান বিস্তারিত লেখ।
অথবা, যুক্তিবিদ্যায় আল-ফারাবির অবদান বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: দর্শন চর্চার প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে গণিতের ন্যায় যুক্তিবিদ্যা বিষয়ক জ্ঞান একান্ত অপরিহার্য। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভারত ও চীনে যুক্তিবিদ্যার চর্চা ছিল। তাই যুক্তিবিদ্যা চর্চার ইতিহাস সুপ্রাচীন ও ব্যাপক। আল ফারাবির যুক্তিবিদ্যা ব্যাকরণের উপর মন্তব্য ও টাকা এবং জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনাকে অন্তর্ভুক্ত করে। যুক্তিবিদ্যা চিন্তার উপাদান নিয়ে যাত্রা শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে অতি জটিল ধারণায় প্রবেশ করে।
যুক্তিবিদ্যায় আল ফারাবির অবদান: যুক্তিবিদ্যার জনক হিসেবে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলকে বলা হয় প্রথম শিক্ষক। আর এরিস্টটলের দর্শন বিশেষ করে মুক্তিবিদ্যা চর্চা এবং নানামুখি মৌলিক গবেষণার ব্যাপকতার কারণে আল ফারাবিকে বলা হয় দ্বিতীয় শিক্ষক। তাই যুক্তিবিদ্যার উপর আল ফারাবি অনেক কাজ করেছেন। নিম্নে যুক্তিবিদ্যায় তাঁর অবদান আলোচনা করা হলো:
১. যুক্তিবিদ্যা সত্য নির্ধারণে সহায়ক: সাল ফারাবির মতে, যুক্তিবিদ্যার কিছু নিয়মকানুন আছে যা দ্বারা সত্যকে অর্জন করা এবং ভ্রান্তিকে পরিহার করা সম্ভব হয়। সঠিক চিন্তার মাধ্যমে যুক্তিবিদ্যা মানুষকে দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। যুক্তিবিদ্যা অবধারণ, ধারণার অর্থ ও তাৎপর্য এবং বচনের সত্যতা প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করে। তাই প্রত্যেকটি মানুষকে সঠিক পথ নির্দেশ করতে যুক্তিবিদ্যা সহায়তা করে থাকে।
২. সঠিকভাবে পরিচালনাকারী বিদ্যা: আল ফারাবির মতে, যুক্তিবিদ্যা সবসময় মানুষের চিন্তাকে সুষ্ঠু, সুশৃঙ্খল ও সঠিকভাবে পরিচালনা করে। যুক্তির বৈধতা অবৈধতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যুক্তিবিদ্যা অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। চিন্তার যথার্থতার উপর সকল বিষয়ের যথার্থতা নির্ভর করে। তাই আল ফারাবি যুক্তিবিদ্যাকে গঠনমূলক চিন্তার বিজ্ঞান বলে অভিহিত করেন।
৩. স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম অনুসরণ: যেসব বিষয়কে স্বতঃসিদ্ধ বলে গ্রহণ করা হয় তার সত্যতা নিয়ে কখনো প্রশ্ন করা যাবে না। সেগুলোকে বিনা বিচারে পর্যালোচনা করে মেনে নিতে হবে। যুক্তিবিদ্যার বিরুদ্ধ নিয়ম ও মধ্যম রহিত নিয়ম নামে কিছু স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। তবে আল ফারাবি যুক্তিবিদ্যার বিরুদ্ধ নিয়মকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। সমকালীন ব্রিটিশ ভাববাদী দার্শনিক ব্রাডলী ও আধুনিক জার্মান বুদ্ধিবাদী দার্শনিক লাইবনিজও বিরুদ্ধ নিয়মের কথা বলেছেন।
৪. মানুষের চিন্তার ‘ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ: মানুষ সামাজিক ও চিন্তাশীল জীব। তাই মানুষের চিন্তা থাকলে তাকে সম্প্রসারিত করা খুবই সহজ। তবে মানুষের গঠনমূলক চিন্তা করা খুবই দরকার। যুক্তিবিদ্যা মানুষের চিন্তার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। তাই যুক্তিবিদ্যাকে একটি চিন্তার বিজ্ঞানও বলা যেতে পারে। তাই আল ফারাবী বলেন, মানুষের বৃদ্ধিবৃত্তি যুক্তিবিদ্যা বিকশিত করার কাজে সাহায্য করতে পারে।
৫. যুক্তিবিদ্যা গণিত নয়: আল ফারাবির মতে, গণিতশাস্ত্র আকারগত বিদ্যা। আর যুক্তিবিদ্যা আংশকিভাবে আকার গত বিদ্যা হলেও পুরোপুরি আকারগত বিদ্যা নয়। তিনি যুক্তিবিদ্যাকে কখনো গণিতের মতো মনে করেন নি। যুক্তিবিদ্যা বস্তুগত সত্যতা নির্ণয়ের প্রত্যাশী।
৬. উচ্চতর যুক্তিবিদ্যাই দর্শন: আল ফারাবির মতে, “Philosophy is the ultimate stage of logic.” তিনি দেখাতে চেষ্টা করেন যে, দর্শন সবসময় অজানাকে জানতে চায়, জগৎ ও জীবনের রহস্য উদঘাটন করতে চায়। পরম বাস্তবতাকে জানতে চায়। দর্শনের মূল হাতিয়ার হলো যুক্তি। তাই উচ্চতর যুক্তিবিদ্যাই হলো দর্শন।
৭. ব্যাকরণের সাথে তুলনা: আল ফারাবির মতে, যুক্তিবিদ্যা ব্যাকরণের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ব্যাকরণ যেমন- শব্দ, বাক্য, বচন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে, যুক্তিবিদ্যাও তেমনি অবধারণ অনুমান, ধারণা প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করে। তাই আল ফারাবি বলেন, ব্যাকরণের পদ্ধতি, বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে যুক্তিবিদ্যার সাথে অমিল রয়েছে। ব্যাকরণ ভাষার অর্থ বোধকতার উপর জোর দেয়া। আর যুক্তিবিদ্যা কোন বচন বা উক্তির বৈধতার উপর জোর দেয়।
৮. জ্ঞানবিদ্যার সাথে যুক্তিবিদ্যার সম্পর্ক: আনবিদ্যার সাথে যুক্তিবিদ্যার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে আল ফারাবি মনে করেন। তিনি বলেন, যুক্তিবিদ্যা শুধু চিন্তা নিয়েই আলোচনা করে না। আনের উৎপত্তি, সীমা, বৈধতা, শর্ত ইত্যাদি নিয়েও যুক্তিবিদ্যা আলোচনা করে। জ্ঞানের দুটি দিক রয়েছে। যথা সম্ভাব্য জ্ঞান ও অনিবার্য জ্ঞান। যথার্থ জ্ঞান লাভকরতে হলে অনিবার্য জ্ঞান পেতে হয়। আর যুক্তিবিদ্যা অনিবার্য জ্ঞান লাভে সাহায্য করে। সুতরাং ফারাবির মতে, যুক্তিবিদ্যার সাথে জ্ঞানবিদ্যার সম্পর্ক খুবই গভীর।
৯. নীতিবিদ্যার সাথে যুক্তিবিদ্যার সম্পর্ক: আল ফারাবির মতে, নীতিবিদ্যার সাথে যুক্তিবিদ্যার কিছু সম্পর্ক রয়েছে। তিনি দেখেন যে, নীতিবিদ্যা যেমন মানুষের ঐচ্ছিক আচরণের বৈধতা নিয়ে আলোচনা করে, তেমনি যুক্তিবিদ্যাও যুক্তির বৈধতা নিয়ে আলোচনা করে। নীতিবিদ্যার লক্ষ্য যথার্থতা, আর যুক্তিবিদ্যার লক্ষ্য যৌক্তিকতা। অযৌক্তিক আচরণ কখনো শান্তি আনয়ন করতে পারে না। আল ফারাবি যুক্তিবিদ্যাকে শান্তি অর্জনের সহায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
১০. অলংকার শাস্ত্রের তুলনা: যুক্তিবিদ্যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে সত্য নির্ধারণ, যুক্তির বৈধতা বিচার। সত্যতা ও বৈধতার মধ্যে কোন আবশ্যিক সম্পর্ক নেই। আল ফারাবি যুক্তিবিদ্যাকে অলংকারিক শাস্ত্রের মতো বলে চিহ্নিত করাকে সমর্থন করেন নি। যুক্তিবিদ্যা অলংকার শাস্ত্র থেকে পৃথক বলে মনে করেন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, যুক্তিবিদ্যার রাজ্যে মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে আল ফারাবি ছিলেন অন্যতম। এরিস্টটল হলেন যুক্তিবিদ্যার রাজ্যে প্রথম গুরু, আর দ্বিতীয় গুরু হলো আল ফারাবি। এমনকি যুক্তিবিদ্যায় আল ফারাবি তাঁর শিক্ষকদের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। সুতরাং যুক্তিবিদ্যায় আল ফারাবি যে অবদানের স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছেন তা নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য।