যুক্তিবিদ্যা চর্চার ইতিহাস আলোচনাপূর্বক আল-ফারাবির জীবনে যুক্তিবিদ্যার ঐতিহ্য বর্ণনা কর।

অথবা, সংক্ষেপে যুক্তিবিদ্যা চর্চার ইতিহাস আলোচনা কর। আল-ফারাবির জীবনে যুক্তিবিদ্যার ঐতিহ্য বর্ণনা কর।

অথবা, যুক্তিবিদ্যা চর্চার ইতিহাস উল্লেখপূর্বক আল ফারাবির জীবনে যুক্তিবিদ্যার ঐতিহ্য বিশ্লেষণ কর।

অথবা, যুক্তিবিদ্যা চর্চার ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও। আল-ফারাবির জীবনে যুক্তিবিদ্যার ঐতিহ্য ব্যাখ্যা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: মুসলিম দর্শন পিরামিডের ভিত্তিস্বরূপ ছিলেন আল-ফারাবি। দার্শনিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে আল-ফারাবি ছিলেন মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে অন্যতম। তুর্কির আল-ফারাবি ইসলামের ভাবধারার সাথে গ্রিক দর্শনের সমন্বয় সাধনের প্রয়াস অব্যাহত রাখেন। আল-ফারাবির যুক্তিবিদ্যা শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিশ্লেষণ নয়। তাঁর যুক্তিবিদ্যা ব্যাকরণের উপর মন্তব্য ও টীকা এবং আনতত্ত্বের আলোচনাকে অন্তর্ভুক্ত করে। আল-কিন্দির মত আল-ফারাবির তথাকথিত এরিস্টটলের থিয়োলজিকে মূলগ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করেন।

যুক্তিবিদ্যা চর্চার ইতিহাস: যুক্তিবিদ্যা চর্চার ইতিহাস প্রাচীন ও ব্যাপক। প্রাচীন ও মধ্যযুগে যুক্তিবিদ্যার চর্চা ছিল ভারত ও চীনে। যুক্তিবিদ্যার চর্চা আরবি ভাষাভাষী মুসলিম দার্শনিকেরাও করেছেন। যুক্তিবিদ্যার ইতিহাসে অষ্টম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত আরবদের, বিশেষ করে মুসলিম দার্শনিকদের অবদান উল্লেখযোগ্য।

ইরাক, ইরান, সিরিয়া, মিশর, আলেকজান্দ্রিয়া জয় করার পর মুসলমানেরা এসব চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসেন এবং পরবর্তীকালে দর্শন চর্চায় খ্যাতি লাভ করেন। যুক্তিবিদ্যার রাজ্যে প্রথম গুরু হলেন এরিস্টটল আর দ্বিতীয় শুরু আল-ফারাবি। আল-ফারাবি ছাড়াও যুক্তিবিদ্যায় আরও যারা পারদর্শী ছিলেন তাদের মধ্যে আবু বাশার মাতা ইবনে ইউনুস, আল-কিন্দি, ইয়াহইয়া বিন আদি, ইবনে সিনা, আল-গাজালি, আবু সালত, ইবনে রুশদ, ফখরুদ্দিন রাযী, আল-খুনাজি, উরমাভি, কামালউদ্দিন ইবনে ইউনুস, নাসির উদ্দিন তুসি, আল-কাজভিনি, আল কাতেবি, তাসতুরি, ইবনে তাইমিয়া প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

নবম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের খ্যাতনামা অধ্যাপক নিকোলাস রেসার এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফিলসফিতে আরবি ভাষাভাষী যুক্তিবিদদের অবদান সম্পর্কে একটি অধ্যায় সংযোজন করেছেন।

আল-ফারাবির জীবনে যুক্তিবিদ্যার ঐতিহ্য: আল-ফারাবির মতে, কালদিয়ান সাম্রাজ্যে (আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টপূর্ব) ইরাকি চিন্তাবিদদের দ্বারা জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয়। সে ধারা পরবর্তীকালে ইরাক থেকে মিশর, মিশর থেকে গ্রিসে এবং গ্রিস থেকে সিরিয়া এবং তারপর সিরিয়া থেকে আরবদের কাছে স্থানান্তরিত হয়।

ইউহান্না বিন হাইলান (আনুমানিক ৮৬০-৯২০ খ্রি.) এবং আবু বিশার মিতা ইবনে ইউনুসের (আনুমানিক ৮৭০-১৪০খ্রি.) নিকট থেকে আল-ফারাবি যুক্তিবিদ্যা শিক্ষা করেন। আল-ফারাবির যুক্তিবিদ্যার শিক্ষকেরাও পরিচিত ব্যক্তিত্ব। আল-ফারাবি যুক্তিবিদ্যায় তাঁর শিক্ষকদের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞান অর্জন করেছিলেন এবং তাঁর প্রভাব ও পরিচিতিও অনেক বেশি ব্যাপক।

আল-ফারাবির মুক্তি-কিতা সংক্রান্ত প্রস্থাবলি: যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কিত আল-ফারাবি যেসব বিষয় নিয়ে
আলোচনা করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে।

ক. যুক্তিবিদ্যার পরিচিতি (ইস্যগুজি),

খ. মৌলিত আনসূত্র (মাকুলাত),

গ. বিশ্লেষণ বিজ্ঞান (ইবারাত),

ঘ. ন্যায় অনুমান (কিয়াস),

ঙ. প্রতিপাদন বা সন্দেহাতীত প্রমাণ (বুরহান),

চ. বিতর্কমূলক সংলাপ (Dialectical Discourse),

ছ. অলংকার শাস্ত্র (খেতাবাহ),

জ. কাব্যতত্ত্ব (শিব) এবং

ঝ. যুক্তিবিদ্যায় ভাষার প্রয়োগ পদ্ধতি।

আল-ফারাবির যুক্তিবিদ্যার উপর লিখিত গ্রন্থের মধ্যে কয়েকটির নাম নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

১. কিতাব আল তাওতিয়া কি আল মানতিক: যুক্তিবিদ্যার এটি পরিচিতিমূলক গ্রন্থ। ইংরেজি ভাষায় গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রজ্ঞা ও স্বজ্ঞাভিত্তিক আন সম্পর্কীয় আলোচনা রয়েছে এ গ্রন্থে। সাত্ত্বিক ও আপাতনিক বস্তুর প্রকৃতির বিশ্লেষণ সরল ও যৌগিক পদের বিশদ বিবরণ রয়েছে।

২. কিতাব ইসাগুজি: যুক্তিবিদ্যার পরিচিতিমূলক গ্রন্থ হিসেবে এটিও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ গ্রন্থে অবধারণের প্রকৃতি, শ্রেণীকরণ, সার্বিক ও বিশেষ, সরল ও যৌগিক ধারণার বিচার বিশ্লেষণ প্রভৃতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

৩. রিসালা সুদেরা বিহা আল কিতাব: ১৯৫৭ সালে ডি. এম. ডানলপ যুক্তিবিদ্যার পরিচিতিমূলক এ নিবন্ধটি
সম্পাদনা ও ইংরেজি অনুবাদ করেছেন।

৪. শরহে কিতাব আল মাকুলাত লি আমান্ততালিস: এরিস্টটলের মৌলিক সূত্র বা ক্যাটেগরির ভাষ্য এ গ্রন্থটি। ইংরেজি ভাষায় এটি অনুবাদ করা হয়েছে। আনসূত্রের বিশদ বিবরণ এবং সার্বিক বিশেষ দ্রব্য, পরিমাণ, গুণ, সম্বন্ধ, দেশ ও কালের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণ এবং আরও অনেক কিছু এতে রয়েছে।

৫. শরহে কিতাব আল ইবারাহ লি আরান্ততালিস: এরিস্টটলের বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থের ভাষ্য এটি। ১৯৬১ সালে বৈরত থেকে সম্পাদিত হয় এ গ্রন্থটি।

৬. কিতাব আল কিয়াস আল সাগির: ন্যায় অনুমানের একটি সংক্ষিপ্ত ভাষ্য এ গ্রন্থটি। এখানে নিরপেক্ষ যুক্তিবাক্য, নিরপেক্ষ ন্যায় অনুমান, সরল ও যৌগিক ন্যায় অনুমান প্রভৃতি বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে। এ গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ ও বিশ্লেষণ করেছেন নিকোলাস রেসার (Nicholas Rescher)। তাঁর ধারণা এরিস্টটল যুক্তিবিদ্যার ছোট, বড়, মাঝারি ধরনের তিন প্রকার ভাষ্য রচনা করেছিলেন। এরিস্টটলের অনুসরণে আল-ফারাবি তিন প্রকার ভাষ্য রচনা করেন।

৭. কিতাব শারায়েত আল কুরআন: যুক্তি প্রমাণ বা প্রতিপাদনের শর্তাবলি বিষয়ক গ্রন্থ এটি। ডি. এম. ডানলপ এ গ্রন্থটির কিছু অংশ সম্পাদনা করেছেন। ডি. এইচ সলমান মধ্যযুগীয় ল্যাটিন ভাষায় গ্রন্থটির অনুবাদ করেছেন। পি. এইচ.. ডি থিসিসের অংশবিশেষ হিসেবে এ গ্রন্থের দুটো অধ্যায় ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৪৫ সালে খলিল গেওর প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে এ গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করেছেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আল-ফারাবির জীবনে যুক্তিবিদ্যার ঐতিহ্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি মনে করেন, যুক্তিবিদ্যা শুধু চিন্তার সামঞ্জস্যতার বিজ্ঞান নয়, কিংবা কেবলমাত্র পদ্ধতি বিজ্ঞানও (Methodology) নয়, এটা এর চেয়েও বেশিকিছু। যুক্তিবিদ্যা দর্শনের একটি অপরিহার্য অংশ এবং দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা পরস্পর পরিপূরক। যুক্তিবিদ্যার কাজ হচ্ছে আত ও সুপ্রতিষ্ঠিত ধারণা দিয়ে শুরু করা এবং যা কিছু পূর্বে অজ্ঞাত ছিল এমন কিছু তাদের থেকে নিঃসৃত করা। এভাবে যুক্তিবিদ্যা জ্ঞাত থেকে অজ্ঞাতের দিকে ধাবিত হয়।