যুদ্ধবিধান্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সংস্কার সম্পর্কে শেষ পদক্ষেপগুলো আলোচনা কর।

অথবা, নব্য স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সংস্কার সম্পর্কে বিস্তারিত লিখ। আলোচনা কর।

অথবা, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শিক্ষা সংস্কার সম্পর্কে

অথবা, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অর্থনৈতিক সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অবস্থা সব দিক থেকে ভেঙে পড়ে। পাকবাহিনী এ সময় বাংলার শিক্ষা, সমাজ, অবকাঠামো ও অর্থনীতি সবক্ষেত্রে ধ্বংসলীলা চালায়। এ সময় দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ চলাকালে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকে এবং পাকবাহিনী অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেয়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশের অর্থনীতি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু সরকার আত্মনিয়োগ করে। নিচে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:

শিক্ষা সংস্কার: বঙ্গবন্ধু সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। কারণ দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এ সময় অনেক শিক্ষক শহিদ হন। ফলে শিক্ষক সংকট দেখা দেয়। এছাড়া শিক্ষা ও সংস্কারের আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন আঙ্গিকে শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা। এ লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে সংবিধানেও সর্বজনীন শিক্ষা প্রবর্তনের অঙ্গীকার করা হয়।

শিক্ষা কমিশন গঠন: ১৯৭২ সালে ক্ষমতা গ্রহণের ৬ মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ জুলাই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। ড. কুদরত-ই-খুদা প্রায় দেড় বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে পর্যালোচনার মাধ্যমে একটা রিপোর্ট প্রণয়ন করেন। এতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে কুদরত-ই-খুদা ১৯৭৪ সালের ৩১ মে সরকারের নিকট তার রিপোর্ট পেশ করেন। এ শিক্ষা কমিশন যখন জরিপ পরিচালনা করছে বঙ্গবন্ধু তখন শিক্ষা ক্ষেত্রে কতকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

১. মার্চ ৭১ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত সময়কালের ছাত্রদের সকল বকেয়া টিউশন ফি মওকুফ করেন।

২. আর্থিক সংকট থাকার পরও বঙ্গবন্ধু পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পুস্তক বিতরণ করেন এবং ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ঘোষণা করেন।

৩. শিক্ষকদের ৯ মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ করেন।

৪. দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করেন।

৫. ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেন।

৬. সমগ্র দেশে তিনি ৯০০ কলেজ ভবন ও ৪০০ মাধ্যমিক স্কুল স্থাপন করেন। এছাড়া বাংলা শিক্ষা বা বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার নামে অফিস আদালতে বাংলা চালুর কঠোর আদেশ দেন।

কুদরত-ই-খুদা কমিশন: কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ নিচে আলোচনা করা হলো:

১. একটা সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

২. প্রথম থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা হিসেবে গণ্য করা হবে।

৩. ১৯৮০ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা বা ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক যে শিক্ষা চালু তা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৪. ১৯৮৩ সালের মধ্যে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত এক অভিন্ন ধরনের অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করতে হবে।

৫. মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয় ভবিষ্যৎ দেশের কর্মসংস্থান অনুযায়ী এর বিষয়বস্তু ঠিক করতে হবে।

৬. ৯ম শ্রেণি থেকে শিক্ষা দুইভাবে বিভক্ত হবে।

ক. বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও
খ. সাধারণ শিক্ষা।

উভয় ধারাতে অবশ্য কয়েকটি বিষয় পাঠ্য থাকবে। এছাড়া অন্য কিছু বিষয় ছাত্ররা স্বনির্বাচিত ধারায় বেছে নেবে।

৭. বৃত্তিমূলক ধারায় মাধ্যমিক শিক্ষা হবে তিন বছরের।

৮. সাধারণ ধারায় মাধ্যমিক শিক্ষা হবে ৪ বছরের।

ড. কুদরত-ই-খুদা ১৯৭৪ সালে যে রিপোর্ট পেশ করেন তা বাস্তবায়নের পূর্বে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।

অর্থনৈতিক সংস্কার: বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকার গঠিত হওয়ার পর সরকার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কয়েকটি ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ১৯৭৩ এর নির্বাচনের পূর্বে সরকার প্রায় ৮০ ভাগ শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত করে। ভূমি মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা ১০০ বিঘা ও ২৫ বিঘা পর্যন্ত সরকার খাজনা মওকুফ করে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে একটা পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সরকার ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই থেকে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কার্যকর করা হয়। এ পাঁচশালা বন্দোবস্তের অন্যতম কারণ হলো:

১. দরিদ্র হ্রাস করা।

২. অর্থনীতির প্রতিখাতে তথা কৃষি ও শিল্পের পুনর্গঠন ও উৎপাদন বৃদ্ধি।

৩. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৩% থেকে ৫.৫% এ উন্নীত করা।

৪. নিত্যপণ্য সামগ্রীর উৎপাদন বৃদ্ধি করা।

৫. বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করা।

৬. কৃষির প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নিশ্চিত করা। খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা।

তবে শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের মতো তিনি এ পঞ্চবার্ষিকী পূরণ করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু এছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

১. প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনায় বিদেশি সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা ৬২% থেকে ২৭% এ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন।

২. বাংলাদেশ শিল্পঋণ সংস্থা ও বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের ১০৫০টি শাখা স্থাপন করেন।

৩. নতুন ৪টি করপোরেশন গঠন করেন। যেমন-

ক. বাংলাদেশ সুগার করপোরেশন,
খ. বাংলাদেশ জুট করপোরেশন,
গ. বাংলাদেশ টেক্সটাইল করপোরেশন ও
ঘ. বাংলাদেশ গ্যাস এন্ড অয়েল করপোরেশন।

৪. বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন।

৫. নতুন মুদ্রা চালু করেন।

৬. পল্লিউন্নয়নের জন্য বগুড়ায় ‘পল্লী উন্নয়ন একাডেমী’ প্রতিষ্ঠা করেন।

৭. এছাড়া তিনি ঘোড়াশাল সার কারখানা ও অন্যান্য স্থানে অনেক শিল্পকারখানা নির্মাণ করেন।

কর্মচারীদের কল্যাণার্থে গৃহীত ব্যবস্থা: যুদ্ধ পরবর্তী সময় প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার মতো অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ছিল না। তবুও সদ্য স্বাধীন হওয়া মানুষের আকাঙ্ক্ষা পরিপূরণ করার জন্য কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতন কমিশন গঠন করেন। এ সময় তিনি ১০ স্তর বিশিষ্ট বেতন স্কেল বাস্তবায়ন করেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়নে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেক ভূমিকা রাখেন। এর ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ অনেক সমৃদ্ধি অর্জন করে।