অথবা, যে পরিস্থিতিতে ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেওয়ানি হস্তান্তর করা হয় তা ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: ভূমিকা: বাংলার ধনসম্পদ ও ঐশ্বর্যের কাহিনী যুগে যুগে বিদেশী পর্যটক ও বণিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তাদের কেউ পর্যটনের উদ্দেশ্যে, কেউ বা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে এদেশে এসেছিল। কিন্তু এদেশে দীর্ঘদিন বসবাসের ফলে তাদের উদ্দেশ্যের পরিবর্তন হয়। তাই তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজ হাতে নেওয়ার চেষ্টা করেন। ফলে প্রথমে ১৭৫৭ সালে ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের ভিক্তি স্থাপন করেন। আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভ ছিল ঘটনা প্রবাহের অতি স্বাভাবিক পরিণতি। জায়
দেওয়ানি লাভের পশ্চাতে বিভিন্ন পরিস্থিতি: ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি হস্তান্তর করা হলেও এর পশ্চাতে বিভিন্ন পরিস্থিতি ও ঘটনাপ্রবাহ কাজ করেছিল। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিস্থিতি ও ঘটনাপ্রবাহ নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. মুঘল আমলে ইংরেজদের আগমন: মুঘল আমলে বাণিজ্যের সূত্র ধরে ইংরেজরা প্রথমে ভারতবর্ষে আসে এবং ধীরে ধীরে তারা বাণিজ্য বিস্তার করে। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে হরিহরপুরে একটি কুঠি স্থাপন করেন। পরে হুগলি, ও কাশিমবাজার প্রভৃতি স্থানেও বাণিজ্য কুটি গড়ে তোলেন। ১৬৫১ ভাসালে বাংলার সুবাদার শাহ সুজার সময়ে ইংরেজ বণিকগণ মাত্র তিন হাজার টাকা বাৎসরিক রাজস্বের মাধ্যমে বাংলায় অবাধ । বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে। ১৬৮০ সালে সম্রাট নিজে ১ একটা ফরমান দ্বারা পণ্য দ্রব্যের উপর শতকরা দু’টাকা এবং জিজিয়া কর হিসেবে শতকরা দেড় টাকা সাম্রাজ্যের সর্বত্র বাণিজ্য করার অধিকার দেন।
২. বাণিজ্য কুটিতে দুর্গ নির্মাণ : বাংলায় অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের সুবাদে সুবাদার ইব্রাহিম কোম্পানিগুলোকে তাদের স্ব-স্ব প্রধান কুটিতে দুর্গ স্থাপনের অনুমতি প্রদান করেন। এ সুযোগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬৯৬ সালে সুতানটি কুটিতে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করে এবং পরবর্তীতে দুর্গটিকে সামরিক সরঞ্জামাদি ও অস্ত্র দ্বারা সুরক্ষিত করে তোলে। কেননা দুর্গ নির্মাণের মাধ্যমে কোম্পানি এদেশে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের যে প্রথম ভিক্তি স্থাপন করে তাতে বাধা দেওয়ায় নবাবের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।०८
৩. ইস্ট মুঘল সংঘর্ষ: মুঘল আমলে ইংরেজদের বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার দেওয়া হলেও কোম্পনির কর্মচারীদের। অন্যায়ভাবে বাণিজ্যের জন্য গোলযোগ দেখা যায়। এ ধরনের – অবস্থায় ‘১৬৮৬’ সালে তারা হুগলি আক্রমণ করলে মুঘল ও ইংরেজদের মধ্যে সংঘর্ষ আরম্ভ হয়। এক বছর পর ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হিথ একটি নৌবহরসহ ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসে চট্টগ্রাম আক্রমণ করলে ইস্ট-মুঘল সংঘর্ষ আরম্ভ হয়।
৪. ইংরেজদের জমিদারি লাভ: ১৬৯৬ সালে ইংরেজরা – সুতানটি নামে যে নব-কুঠির নির্মাণ করেন তা সুরক্ষিত করার অধিকার লাভ করেন। ১৭০০ সালে ইংরেজরা কলকাতায় একটি – দুর্গ নির্মাণ করে ইংল্যান্ডের তদানীন্তন রাজা তৃতীয় উইলিয়ামের – নামানুসারে নাম রাখেন ফোর্ট উইলিয়াম। চাপ কমায়াক চোটি
৫. পলাশীর যুদ্ধ: ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পরিকল্পিতভাবে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে রবার্ট ক্লাইভ বাংলা তথা ভারত বর্ষে ইংরেজ শক্তি প্রতিষ্ঠা করে। নবাব পলায়ন জ করতে গিয়ে ধরা পরে মুহাম্মদ বেগ কর্তৃক নিহত হন। কোম্পানির ল আধিপত্য বিস্তারের ফলে ১৭৬৫ সালে ক্লাইভের নেতৃত্বে দ্বৈত । শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় এবং দেওয়ানি লাভ করেন। ভা
৬. বক্সারের যুদ্ধ: নবাব মীর কাসিমের সময় এক পর্যায়ে কোম্পানির সাথে বিরোধ দেখা দেয়। ইংরেজ ও নবাবের সাথে – কয়েকটি যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যুদ্ধে মীর কাসিম পরাজিত হয়। ১৭৬৪ সালে বক্সারের প্রান্তরে মীর কাসীম, শাহ আলম ও সুজা-উদ-দৌলার সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হয়। ফলে কোম্পানির আধিপত্য বিস্তারের পথ পরিস্কার হয়। এ আধিপত্য বিস্তারের থেকে পরে কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করেন। FOREকি দিলশ
৭. কোম্পানির দেওয়ানি লাভ: মীর কাসিম চূড়ান্তভাবে পরাজিত হওয়ায় কোম্পানি মীর জাফরের নাবালক পুত্র নজিমুদ্দৌলাকে বাংলার নতুন নবাবের পদে অধিষ্ঠিত করেন। অন্যদিকে দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের সাথে কোম্পানির পক্ষে রবার্ট ক্লাইভ বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা রাজস্ব দানের বিনিময়ে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি প্রার্থনা করেন। অতঃপর ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লির সম্রাটকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা ও বাংলার নবাবকে ৫৩ লক্ষ ৮৬ হাজার ১ শত ৩১ টাকা ৯ আনা রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করেন।
৮. ফররুখ শিয়ারের ফরমান লাভ: ১৭১৩ সালে গৃহ যুদ্ধের মাধ্যমে বাহাদুর শাহের পৌত্র ফররুখ শিয়ার দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইংরেজদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে মুঘল সম্রাট ১৭১৭ সালে এক ফরমান দ্বারা বাংলা, মাদ্রাজ ও বোম্বাইয়ে বিনাশুল্কে বাণিজ্য অধিকার প্রদান করেন।
৯. আলীবর্দী খানের নীতি: ঐতিহাসিক রবার্ট ওর্ম বলেছেন, “নবাব আলীবর্দী খান রাজকার্যে ও ব্যবসার ক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রাধান্য দিয়েছেন এবং এর ফলে শাসনকার্যে হিন্দুদের প্রভাব প্রতিপত্তি হয়। ফলে সমাজের সব ক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রাধান্য স্থাপিত হয়।
১০. ক্ষমতার ভাগাভাগি : এ ধরনের পারিপার্শ্বিক অবস্থায় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মূঘল সম্রাটের সার্বভৌম ক্ষমতা মেনে নিবে এবং বাংলার নবাবের সাথে ক্ষমতার ভাগাভাগি করে নেবে। এতে কোম্পানির স্বার্থও রক্ষা হবে মুঘল সম্রাটও সন্তুষ্ট থাকবে। মুঘল সম্রাটের সাথে আইনগত সম্পর্ক স্থাপন করলে বাংলা ও ভারতে বসবাসরত অপরাপর বিদেশী বণিকদের সাথে সম্পর্কের অবণতি ঘটার কোনো কারণ থাকবে না।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, সামান্য বাণিজ্যিক সংস্থা থেকে রাজনৈতিক সংস্থায় উত্তরণ ছিল কোম্পানির পক্ষে আকস্মিক কিন্তু তা ছিল বাস্তবতার এক নির্মম পরিহাস। বাণিজ্যিক অধিকার ও কুটি স্থাপন, এদেশিয় রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ, পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ-উদ-দৌলাকে এবং বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিমকে পরাজিত করে কোম্পানি বাংলা তথা ভারত বর্ষ বিজয়ের পথ সুপ্রশস্ত হয়ে যায়। বস্তুত ১৬৫১ সালে শাহ সুজা কোম্পানিকে বাণিজ্যেক সুবিধা দিয়ে যে সনদ দান করেন তারই শেষ পরিণতি ছিল ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক দিওয়ানি লাভ।