রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের সাফল্যের বিবরণ দাও।

অথবা, রাজনীতিবিদ হিসেবে বঙ্গবন্ধু কতটুকু সফল ছিলেন? আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিকাশে এবং বাংলাদেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করার জন্য যিনি সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেসব নেতৃবৃন্দ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে মাতৃভূমিকে ঔপনিবেশিক শাসন হতে মুক্ত করে একটি নতুন জাতির জন্ম দেন, তারা (জওহরলাল নেহেরু, সুকর্ণ, জুমু, কেনিয়থা) এক দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ৩ বছর ৮ মাস ক্ষমতায় থাকার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কতিপয় বিপথগামী সামরিক অফিসার কর্তৃক পরিবারের সকল সদস্যসহ নির্মমভাবে শহিদ হন।

নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাফল্য : সম্মোহনী শক্তিসুলভ নেতা হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষ অবদান রেখেছেন। নিচে সেগুলো আলোচনা করা হলো:

১. আপসহীন নেতৃত্ব: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বঞ্চিত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আপসহীনভাবে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। অন্যায়ের কাছে তিনি কোন অবস্থাতেই মাথানত করেননি। জেল, জুলুম, অত্যাচার, কোনোকিছুই তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছেন। তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, অদমনীয় কর্মস্পৃহা, অপূর্ব বাচনভঙ্গি, সর্বোপরি, তার আকর্ষণীয় চারিত্রিক মাধুর্য তাঁকে সম্মোহনী শক্তিসুলভ নেতৃত্বের অধিকারী করে তুলেছিল।

২. জাতীয় নেতায় পরিণত হওয়া: ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঐতিহাসিক ছয়দফা প্রস্তাব ছিল বাঙালি জাতিয় মুক্তির সনদ। এ ছয়দফাকে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। আর এ কারণেই শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন শুরু করে। কিন্তু বাঙালিরা পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলেই ছয়দফার সপক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়। এ ছয়দফার আন্দোলনই পরবর্তীকালে শেখ মুজিবকে জাতীয় নেতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে।

৩. ছয়দফা কর্মসূচি: আইয়ুব খানের শাসনামলে শোষণ ও বঞ্চনার জাঁতাকলে নিষ্পেষিত পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা যখন মুক্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে ঠিক সে সময় শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে তাঁর ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবি নিয়ে এগিয়ে আসেন। তাঁর নেতৃত্বে ও নির্দেশে ছয়দফা দাবি দলীয় কর্মীদের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র প্রচার করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে ছয়দফার ভিত্তিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানালে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান গণআন্দোলনে উদ্বেলিত হয়ে উঠে।

৪. সফল রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের দ্বারা আইয়ুব সরকারের মতো লৌহমানবের
বেনিকাপাত ঘটে। আইয়ুব সরকারের পতন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমান নব দিগন্তের সূচনা করে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কঠোর ভূমিকা পালন করে যা তাকে সফল রাজনীতিবিদে পরিণত করে।

৫. ১৯৭০ সালের নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মোহনী শক্তিসুলভ নেতৃত্বের আর একটি পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে। ইয়াহিয়া সামরিক আইনের মধ্যে নির্বাচন দেন এবং নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে। নির্বাচনে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তানে একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই ছিলেন সম্মোহনী শক্তিসুলভ নেতৃত্বের অধিকারী।

৬. আতীয় চেতসার উন্মেষ: পাক শাসনামলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশবাসীর মাঝে এক অভাবনীয় জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটান। ফলে শত শত বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বেদীমূলে আত্মাহুতি দিতে কুণ্ঠিত হয়নি। জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের দরুন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। যদি তিনি এ ধরনের ভূমিকা পালন না করতেন তাহলে ইতিহাসের ধারা কোন দিকে প্রবাহিত হতো তা ঠিক করে বলা কঠিন ছিল।

৭. গতানুগতিক সমাজব্যবস্থা অবসানের প্রচেষ্টা : সম্মোহনী শক্তিসুলভ নেতৃত্ব পুরাতন সমাজকে ভেঙে নতুন সমাজব্যবস্থা গড়তে সহায়তা করে। এটা পুরাতন ও নতুনদের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানকে ভেঙে নিজস্ব আঙ্গিকে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন। প্রাণপণ চেষ্টায় এতে তিনি সফলতা লাভ করেন।

৮. স্বাধীনতা সংগ্রাম: ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্যারিসমাটিক নেতৃত্বের আরেকটি অন্যতম দিক। মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ৭ মার্চের ভাষণ। সে ভাষণ বাংলার সর্বস্তরের জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছে।

৯. স্বাধীন দেশের নেতৃত্ব দান: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সুদীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালিরা স্বাধীনতা অর্জন করে এবং স্বাধীনতা অর্জনের অল্প কিছুদিন পরে অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে বাংলাদেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর অসামান্য নেতৃত্বের জন্য দ্রুত ভারতীয় সৈন্যরা স্বদেশে ফিরে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্র সমর্পণ করেন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধু একটি নাম একটি কিংবদন্তি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে এ মহান নেতার হাত ধরে। বিশ্বের ইতিহাসে এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল। আর তাই বলা যায়, রাজনীতিবিদ হিসেবে বঙ্গবন্ধু সর্বাপেক্ষা সফল ছিলেন।