অথবা, আল-গাজালির মতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের পদ্ধতিগুলো কি কি?
অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে আল-গাজালির পদ্ধতি আলোচনা কর।
অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের পদ্ধতি সম্পর্কে আল-গাজালির ধারণা নিশ্লেষণ কর।
অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে আল-গাজালির পদ্ধতি বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: একাদশ শতকে ইসলামি ধর্মতত্ত্ব ও মুসলিম দর্শনে এক সংকটকাল বিরাজ করছিল। একসিকে সমগ্র মুসলমানেরা খ্রিস্টানের সাথে ক্রুসেড বা ধর্ম যুদ্ধে লিপ্ত। অন্যদিকে, তারা বিভিন্ন সভ্যতা, শিক্ষা, সম্পদ ও গ্রিক দর্শনের মোকাবিলায় ব্যাপৃত। ম্যাকডোনাল্ডের ভাষায়, “সময়ের প্রয়োজনে যে মানুষটি আবির্ভূত হলেন, তিনি ছিলেন এল-গাজালি। নিঃসন্দেহে তিনি মুসলমানদের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে সহানুভূতিশীল পণ্ডিত ও পরবর্তীকালের বংশধরদের জন্য একমাত্র ধর্ম শিক্ষক। যাঁকে মুসলমানেরা মহান চার ইমামের সাথে গণনা করেছেন।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে গাজালির পদ্ধতি: প্রত্যেকটি দার্শনিক তথা চিন্তাবিদদের কিছু না কিছু পদ্ধতি থাকে, যেমনটি ছিল গাজালির। এ পদ্ধতির কণেই রাষ্ট্রনায়ক ও দার্শনিকগণের জীবনে উত্থানপতন ঘনিয়ে আসে। যেমন বলা যায়, এরিস্টটল এর রাষ্ট্র পদ্ধতির জন্য তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক হিসেবে খ্যাত। কিন্তু সক্রেটিস তাঁর শিক্ষাগুরু হয়েও এ গৌরব অর্জন করতে পারেন নি। রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে তিনি নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলোর কথা বলেছেন। যেমন-
১. শাসকের প্রয়োজনীয়তা: গাজালি বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা ও মানুষের পার্থিব
কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন শক্তিশালী শাসকের প্রয়োজন। কারণ শাসক ছাড়া রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানকারী কোন সংস্থা গড়ে উঠতে পারে না। তাঁর মতে, শাসক হবেন রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ নেতা এবং তিনি পরম নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলার সাথে আল্লাহর নির্দেশসমূহ বাস্তব রূপদান করবেন।
২. রাষ্ট্র ও আইন: গাজালি বলেছেন, মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে সুষ্ঠু জীবনযাপন ও সমাজ পরিচালনার জন্য আইন এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজন রয়েছে। তাই তিনি বলেছেন, আইন কানুন একজনের উপর আরেকজনের অন্যায় হস্তক্ষেপকে বাধা দেয় এবং সকলের গণতান্ত্রিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করে। আর রাষ্ট্রই কেবলমাত্র আইন কানুনকে সকলের জন্য কার্যকরী করতে পারে।
৩. রাষ্ট্র ও ধর্ষ: দ্বাদশ শতাব্দীতে গাজালি রাষ্ট্রনীতিতে যে নতুন ন্যায় সংযোগ করেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। রাষ্ট্রনীতি যে ধর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত তা তিনি বার বার ঘোষণা করেছেন। তাঁর মতে, মানবসমাজের ভিত্তি হচ্ছে ধর্ম এবং এর সমকক্ষ হচ্ছে রাষ্ট্র। পারলৌকিক সুখশান্তি লাভ করতে হলে মানুষকে ধর্মের নির্দেশ মোতাবেক কর্তব্য করে যেতে হবে।
৪. রাষ্ট্র ও জীবদেহের তুলনা: গাজালী রাষ্ট্রকে জীবদেহের সাথে তুলনা করে রাষ্ট্রতত্ত্বকে এক নতুন আলোকে আলোকিত করে তোলেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্র সত্তাকে সম্পূর্ণরূপে একটা জীবদেহের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। তাঁর মতে, শাসন বিভাগের কর্মকর্তা, পুলিশ, মন্ত্রী ও শাসক প্রধান যথাক্রমে কাষনা, ক্রোধ, সাধারণ বিবেক বুদ্ধি ও হৃদয়ের প্রতীকরূপে বিবেচ্য।
৫. নাগরিকের শ্রেণীবিভাগ ও দাসপ্রথা: তিনি রাষ্ট্রের নাগরিকদের চার ভাগে ভাগ করেছেন। যথা:
ক. কৃষক:
খ. শিল্পী ও কারিগর;
গ. যোদ্ধা বা সেনাবাহিনী এবং
ঘ. শিক্ষিত বা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়।
তিনি গ্রিক দার্শনিকদের মত শ্রেণীগত অসাম্যের ভিত্তিমূলে তাঁর রাষ্ট্রের কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেন নি। তিনি ইসলামি আদর্শে দাসপ্রথার ব্যাখ্যা দেন এবং বলেছেন, যেহেতু ইসলামে অসাম্যের কোন স্থান নেই সেহেতু ক্রীতদাসের প্রতিও সাম্যের ভিত্তিতে সমান ব্যবহার করতে হবে।
৬. মানুষের শ্রেণীভেন: পন্থা ও পদ্ধতির তারতম্যের ভিত্তিতে গাজালি মানুষকে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। এদের বর্ণনা নিচে দেওয়া হলো:
ক. প্রথম শ্রেণীর মানুষ : এদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর মানুষ প্রকৃত আলেম ও খোদাভীরু, নিজ দোষত্রুটি সম্বন্ধে সচেতন ও সাবধানি, আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভে সদা তৎপর, দুনিয়ার প্রতি বিমুখ এবং আখেরাতের জীবনের প্রতি অনুরাগী, শয়তানের কারসাজি ও কুমন্ত্রণার প্রতি সজাগ।
খ. দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ: দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ হল সে, যে প্রথম প্রকার মানুষের মত তত্ত্বজ্ঞ ও গভীর রহস্যবিদ হয় না বটে, তবু সে পুরোপুরি নামাজি, রোজাদার ও পরহেজগার মুসলমান হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে। এরা সুফি দরবেশ না হলেও খুব সৎ ও মহৎ জীবনযাপন করে। এ ব্যক্তিদের জীবনও সার্থক।
গ. তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ: তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ হল সে, যার কর্মের ফলে অন্যান্য মুসলমান উপকার ও শান্তি পায়। এরা সাধুজন ও সুফি ওলিদের সাহায্য ও সেবা করতে ভালোবাসে, দীন দরিদ্রকে আহার দেয় এবং রোগীদের সেবা করে। এসব কার্যকলাপের সওয়াব নফল এবাদতের চেয়ে কম নয়।
ঘ. চতুর্থ শ্রেণীর মানুষ: চতুর্থ শ্রেণীর মানুষ হল সে, যে নিজের ও পরিবারবর্গের জীবিকার্জন এমনভাবে করে যাতে অন্য কোন মুসলমানের অনিষ্ট না হয় এবং তার হাত ও জিহবা দ্বারা কারও কোন উপকার হয় না এবং সে কোন গুনাহ ও অসৎকর্মের ধারা নিজেদের ধর্মহানী ঘটায় না।
৭. গুপ্তচর প্রথা: গাজালির মতে, রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বা বিভাগ হচ্ছে গুপ্তচর প্রথা। তাঁর মতে, প্রত্যেক রাষ্ট্রেই গুপ্তচর প্রথা থাকা উচিত। কারণ গুপ্তচর প্রথার মাধ্যমেই একটি দেশের শাসক জানতে পারে যে, অন্য রাষ্ট্র তাঁর নিজের দেশ সম্পর্কে কোন ষড়যন্ত্র করছে কি না। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ বিষয়ে গুপ্তচর বাহিনীর মাধ্যমে দেশের প্রকৃত অবস্থা অবহিত হয় এবং সে অনুযায়ী নীতিনির্ধারণ করে।
৮. প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ: রাষ্ট্র পদ্ধতি বিশ্লেষণের এ পর্যায়ে গাজালি প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, “রাষ্ট্রের বিশালায়তনের দিকে নজর রেখে সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ একান্ত দরকার।” তাঁর মতে, কেন্দ্রের হাতে সকল গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে এবং প্রদেশগুলো কিছু কিছু বিষয়ে স্বাধীনতা ভোগ করবে।
৯. রাষ্ট্রের অর্থনীতি ও রাজ কর খাত: আল-গাজালি ক্রয়বিক্রয়ের শ্রেষ্ঠত্ব দ্রব্য বিনিময়ের উপর নির্ধারিত মুদ্রার মাধ্যমে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, কর ধার্যের ব্যাপারে এমন রীতি অবলম্বন করা উচিত যার ফলে প্রজাগণ করপ্রদানে কোন অসুবিধার সৃষ্টি না হয়। এ ব্যাপারে শিল্পপতি ও সরকারকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
১০. রাষ্ট্রের উৎপত্তি: রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে এরিস্টটলের মতানুসারে তিনি বলেছেন যে, মানুষ প্রকৃতগতভাবেই সবসময় পরস্পরের সাহচার্য কামনা করে এবং কখনও একাকী বাস করতে পারে না। তাই তাকে অন্যান্য লোকের সহযোগিতার মাধ্যমে থাকতে হয়। এজন্য তিনি মনে করেন যে, বিভিন্ন পেশাদারি ব্যক্তির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে সামগ্রিক জীবন গড়ে উঠে। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য চারদিকে সুদৃঢ়ভাবে বেষ্টিত করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে থাকে। এরূপ প্রয়োজনের তাগিদেই নগর, বন্দর ও রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। এভাবে তিনি রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দান করেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। রাষ্ট্র যে একটা সহযোগিতামূলক প্রতিষ্ঠান তাই তাঁর রাষ্ট্রীয় দর্শনের মূলসুর।
উপসংহার: গাজালি ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মতত্ত্ববিদ ও সূক্ষ্মতম চিন্তাবিদদের অন্যতম। তিনি ইসলামি ভাবধারা উন্মেষের এক নবদিগন্তের সূচনা করেন। ইসলামি চিন্তাধারার প্রেক্ষিতে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের যে পদ্ধতি এবং রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় ধারণার ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কনেছেন তা রাষ্ট্রনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে সত্যিই বিস্ময়কর অবদান। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু মনীষী, পণ্ডিত তাঁর অবদানকে দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করে নিয়েছেন।