অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান? তোমার মতের সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন কর।
অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান? রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান হিসেবে অভিহিত করার সপক্ষে যুক্তি দেখাও।
অথবা, তুমি কি মনে কর যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি বিজ্ঞান? তোমার উত্তরের সম্পক্ষে যুক্তি দাও।
উত্তর: ভূমিকা: সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে বাস করে আসছে। এ সংঘবদ্ধ জীবনযাপন থেকেই সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের সূত্রপাত। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, মানুষ সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীব।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি বিজ্ঞান কি না: রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান না কলাবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে
মতবিরোধ রয়েছে। চীক দার্শনিক এরিস্টটল বাষ্ট্রবিজ্ঞানকে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান বলে অভিহিত করে তৎকালীন গ্রিক রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের। পর্যালোচনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন। তাঁর চিন্তাধারায় রাজনীতি একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে পরিগণিত হয়। পরবর্তীকালে এরিস্টটলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বদিন, হবস, মন্টেস্কু, সিজউইক, ব্রাইস, হোন্টজেনুডরফ, সোলারি, রোগহাম এবং স্যার ফ্রেডারিক পোলক প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলে অভিহিত করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস গ্রাহাম উইলসনের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলা চলে। কারণ এখানে রাজনৈতিক বিষয়সমূহের বিশ্লেষণ ও শ্রেণিবদ্ধকরণ সম্ভব। এ বিশ্লেষিত ও শ্রেণিভিত্তিক আন হতে সাধারণ সূত্রের প্রতিষ্ঠাও সম্ভব। লর্ড ব্রাইস এর অভিমত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান না কলা এ সম্পর্কে সবচেয়ে সুন্দর তত্ত্ব দিয়েছেন লর্ড ব্রাইস। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে একটি প্রগতিশীল বিজ্ঞান বলে অভিহিত করেছেন। পক্ষান্তরে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বাল, কোঁতে, মেইটল্যান্ড এবং অ্যামস রাষ্ট্রবিজনেকে বিজ্ঞান বলে মেনে নিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। তাঁদের মতে, “বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর পর্যালোচনা সম্ভব নয়।” বাক্সের মতে, “রাজনীতি বিজ্ঞান হওয়া তো দূরের কথা, কলাবিদ্যা হিসেবেও এটা সর্বনিম্ন স্তরের।” (Politics far from being a science is the backward of all arts.) অ্যামস এর
মতে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু এত ব্যাপক ও জটিল যে, এতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার সম্ভবপর নয়।” অধ্যাপক গিলফাইস্টের মতানুসারে, “রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কোন স্থির, নির্দিষ্ট এবং অভিন্ন সূত্রের সন্ধান পাওয়া মুশকিল।”
বিজ্ঞানের পক্ষে যুক্তি: এ বিষয়ের সপক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তির পূর্বে আমাদের বিজ্ঞান সম্পর্কে জানা উচিত। ১৯৫০ সালে ইউনেস্কো এর আলোচনা মতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, “বিজ্ঞান হলো একটি বিষয় সম্পর্কে সুনিয়ন্ত্রিত চিন্ত 1. অভিজ্ঞতা, ভূয়োদর্শন ও গবেষণাপ্রসূত জ্ঞানভাণ্ডার।” অর্থাৎ বিজ্ঞান হলো কোন বিষয় সম্পর্কে সুসংবদ্ধ জ্ঞান। পরীক্ষা নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার দ্বারা এ জ্ঞান সংগৃহীত হয়। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিষয়সমূহের শৃঙ্খলিত জ্ঞানকেই বিজ্ঞান বলা হয়। বিজ্ঞানের সংজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিজ্ঞান কি না তার সপক্ষে নিম্নোক্ত যুক্তির অবতারণা করতে পারি।
১. বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ: বিজ্ঞানে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ভিত্তিক আলোচনাকে প্রাধান্য দেয়। এ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতি, পরীক্ষা নিরীক্ষামূলক পদ্ধতি ও পরিসংখ্যানমূলক পদ্ধতি অন্যতম।
২. তথ্য সংগ্রহ: পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ, গবেষণা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রের উৎপত্তি, কার্যাবলি, শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক, নাগরিকের আচরণ প্রভৃতি বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শ্রেণিকরণ, বিশ্লেষণ প্রভৃতি প্রয়োগ করে সাধারণ সূত্র উদ্ভাবন করা সম্ভব। অন্যান্য বিজ্ঞানের ন্যায় এর তথ্য সংগ্রহও একই।
৩. সংখ্যায়ন সম্ভব: আধুনিক আচরণবাদীদের দৃঢ় অভিমত হলো ভৌত বিজ্ঞানের ন্যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও সংখ্যায়ন পদ্ধতি সাফল্যের সাথে ব্যবহার করা সম্ভব। তথ্যাদি সংগ্রহ ও তা বিশ্লেষণ এবং গণিত ও পরিসংখ্যানের প্রয়োগ ঘটিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে বিষয়মুখী ও মূল্যমান নিরপেক্ষ করা সম্ভব বলে আচরণবাদীরা বিশ্বাস করেন। এ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ, ব্যক্তির আচার আচরণ প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিতভাবে তথ্য সংগ্রহ করেন এবং সংগৃহীত তথ্যাদি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি ধারণ্য কাঠামো গড়ে তোলেন। আধুনিক লেখকগণ মনে করেন যে, পরিসংখ্যান ও ঘটনাভিত্তিক বিচার বিশ্লেষণের দ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ভৌত বিজ্ঞানসমূহের সমমর্যাদাসম্পন্ন করে তোলা সম্ভব।
৪. ভবিষ্যদ্বাণীকরণ: অন্যান্য বিজ্ঞানের আলোচনা, গবেষণা, পরীক্ষা নিরীক্ষা ভবিষ্যদ্বাণী নির্ধারণ করতে সহায়ক হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত ও গবেষণা পরবর্তীতে রাষ্ট্র, সরকার, আইন ইত্যাদি ক্ষেত্রে গবেষণা ও ভবিষ্যদ্বাণী নির্ধারণে সহায়ক হয়।
৫. সুসংবদ্ধ জ্ঞান: মানুষ মননশীল ও ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন। তবুও তার রাজনৈতিক আচরণের মধ্যে যথেষ্ট সামঞ্জস্য থাকে। এ সুসামঞ্জস্য আচরণ থেকে সুসংবদ্ধ জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব। এ সুসামঞ্জস্য আনই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভিত্তি রচনা করে। এ জান ও সূত্রসমূহ ভবিষ্যৎ সমস্যা সমাধানের পথ নির্দেশ করে। অন্য বিজ্ঞানেও একইভাবে সুসামঞ্জস্য জ্ঞান আহরণ করা হয়।
৬. বিষয়ের ব্যাপকতা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ব্যাপক। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞানে যেভাবে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও বর্ণনা করা হয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও সেরূপ পর্যবেক্ষণ, নিরীক্ষণ ও গবেষণাকার্য পরিচালনা করা হয়।
৭. নিয়মনীতির উপস্থিতি : বিজ্ঞানে যেমন সাধারণ সূত্র প্রয়োগ করে সর্বজনীন নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠা করে তেমনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাজনৈতিক গবেষণালব্ধ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক তথ্য ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সাধারণ বিধি গড়ে তোলা যায়। বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক জীবনের উত্থানপতন, কাঠামোর পরিবর্তন ইত্যাদি পর্যালোচনার দ্বারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সর্বজনীন নিয়ম ও নীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
৮. গবেষণাগারের উপস্থিতি: বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য যেমন গবেষণাগারের প্রয়োজন তেমনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও গবেষণাগার আছে। সমগ্র রাজনৈতিক জগৎই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষণাগার। এখানে সবসময়ই মানুষের রাজনৈতিক জীবন ও কার্যাবলি নিয়ে গবেষণা হয়ে থাকে। এজন্যই এরিস্টটলপস্থি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি বিজ্ঞান।
৯. সিদ্ধান্ত গ্রহণ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিভিন্ন বিষয় আলাপ আলোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিজ্ঞানের একটি অন্যতম বিষয় হলো বহুবিধ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এজন্যই রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলে অভিহিত করা যায়। এসব সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা চলে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলে অভিহিত করা যায়। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান হিসেবে অভিহিত না করে সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। কারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলো আলোচনা বা পর্যালোচনা করে।