রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে এরিস্টটলের ধারণা আলোচনা কর।

অথবা, রাষ্ট্রের ধরন সম্পর্কে এরিস্টটলের মতবাদ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, রাষ্ট্রের স্বরূপ সম্পর্কে এরিস্টটলের ধারণা উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল গ্রিকদর্শন, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি মেসিডোনিয়ার উপকূলবর্তী স্ট্যাগিরা নামক স্থানে খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪ অব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে ‘The Politics’ অন্যতম। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার মূল দর্শন এ গ্রন্থে ফুটে উঠেছে। এ গ্রন্থের ৭ম ও ৮ম অধ্যায়ে রাষ্ট্রের যে চিত্র অঙ্কন করেছেন তাকে আমরা আদর্শ রাষ্ট্র না বলে রাষ্ট্রের আদর্শ বলতে পারি।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি: রাষ্ট্রের সামগ্রিক অবস্থা ও কার্যকলাপের ভিত্তিতেই প্রকৃতি বা স্বভাব নির্ধারিত হয়। এরিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্রের প্রকৃতি নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. আয়তন ও জনসংখ্যা: এরিস্টটলের মতে, ‘রাষ্ট্রের আয়তন ও জনসংখ্যা এমন হওয়া উচিত যাতে জনগণ স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে পারে।” তাঁর মতে, জনসংখ্যা ১০ হাজার উত্তম, তবে ১ লক্ষের বেশি হবে না। রাষ্ট্রের আয়তন যতবেশি হয় শক্তি তত হ্রাস পায়।

২. রাষ্ট্রের অবস্থান: এরিস্টটলের মতে, “রাষ্ট্রের কাছাকাছি সমুদ্র উপকূল থাকতে হবে। এর ফলে ব্যবসায় বাণিজ্য সহজ হবে এবং শক্তিশালী নৌবহর দ্বারা বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধ করা যাবে।”

৩. নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া: আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া জরুরি। উষ্ণ অঞ্চলে মানুষের স্বাস্থ্যহানী ঘটে এবং শীতপ্রধান এলাকার মানুষ সংস্কৃতি চর্চায় উদাসীন হয়।

৪. পরিকল্পিত সগর: জনস্বাস্থ্য, রাজনৈতিক সুবিধা এবং যুদ্ধ পরিচালনার কথা বিবেচনা করে নগর ও রাজধানী গড়ে উঠবে। নগর প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত হবে এবং রাস্তাসমূহ প্রশস্ত ও সুবিন্যস্ত করা যাবে না।

৫. নাগরিক দায়িত্ব: এরিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্রে শ্রেণিগত বিভেদ অত্যন্ত প্রবল। তাঁর রাষ্ট্রে কৃষক কৃষিকাজ করবে, বণিকরা ব্যবসায় করবে, কারিগর যন্ত্রপাতি তৈরি করবে এবং দাসগণ প্রভুর আদেশ মেনে চলবে। এদের কোন রাজনৈতিক অধিকার থাকবে না। রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করবে শুধু রাজকর্মচারী, সৈনিক ও পুরোহিতগণ।

৬. বিবাহ ব্যবস্থা: বিবাহ ব্যবস্থা সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সন্তান সংখ্যা রাষ্ট্র নির্ধারণ করবে। কেউ স্বাস্থ্যগত কারণে অক্ষম হলে তার বিয়ে করার অধিকার থাকবে না।

৭. শিক্ষাব্যবস্থা: আদর্শ নাগরিক গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে সবার মুক্ত বুদ্ধির বিকাশ উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকবে।

৮. মানবকল্যাণ: প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে মানবকল্যাণ সাধন করতে হবে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সুষ্ঠু ও সুন্দয় জীবন ব্যবস্থা এবং প্রতিভা বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।

৯. সরকার ব্যবস্থা: এরিস্টটলের মতে, সরকারের উত্তম প্রকৃতি নির্ভর করে দেশ, সময় প্রভৃতি বিষয়ের উপর। তিনি তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে রাজতন্ত্রকে সর্বোৎকৃষ্ট সরকার বলেছেন। তবে তিনি বলেছেন, শাসনতান্ত্রিক সরকারও উত্তম হতে পারে।

১০. রাষ্ট্র সমন্বিত প্রয়াস: এরিস্টটল মনে করেন, রাষ্ট্র হলো একটি সমন্বিত প্রয়াসের নাম। তিনি রাষ্ট্রকে মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গের সাথে তুলনা করেছেন। এটি হলো এরিস্টটলের রাষ্ট্র সম্পর্ককে জৈব মতবাদ।

১১. রষ্ট্রি বিবর্তনের ফসল: এরিস্টটল রাষ্ট্রকে বিবর্তনের ফসল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে রাষ্ট্রের বিকাশ, শ্রীবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সাধিত হয়।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রের উৎপত্তি, প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে এরিস্টটলের ও ব্যাখ্যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। রাষ্ট্র সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন নয়। প্রকৃতপক্ষে, জনগণের সর্বাঙ্গীণ – মঙ্গলের জন্য রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে এবং জনগণের প্রয়োজনে তা টিকে থাকবে। তাই আমরা বলতে পারি প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে এরিস্টটল যে মতবাদ দিয়েছেন তা আজও স্বীকৃত।