রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির কার্যাবলি উল্লেখসহ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির নাম রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি রাখার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে লেখ।

অথবা, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির কার্যাবলি উল্লেখসহ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির নাম রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি রাখার প্রতিক্রিয়া আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: রেডক্রস একটি আন্তর্জাতিক সেবামূলক সংস্থা। এই সংস্থার মূল লক্ষ্যেই দুঃস্থ অসহায় মানুষের কল্যাণ সাধন করা। বিশ্বের প্রায় দেড়শটি রাষ্ট্রে এর কার্যক্রম বিস্তৃত হয়েছে। এটি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে বিশ্বে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ও যুদ্ধবিগ্রহ হতে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানমূলক কার্যাদি তত্ত্বাবধান করাসহ অন্যান্য সমাজসেবামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করছে। মুসলিম বিশ্বে এটি রেডক্রিসেন্ট নামে পরিচিত। আমাদের বাংলাদেশে ও রেডক্রিসেন্ট নামেই এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এটি সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য নিয়ে এর কার্যাবলি অত্যন্ত সুন্দরভাবে সম্প। দন করে দরিদ্র জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে বেশ তৎপরতা দেখাচ্ছে।

রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির কার্যাবলি: রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির কার্যাবলি দিন দিন বেশ সুবিস্তৃত হচ্ছে। এই সোসাইটির কার্যাবলি নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. জরুরি খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি: রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে জরুরি খাদ্য বিতরণ। বাংলাদেশে ৭১-এর যুদ্ধপরবর্তী অবস্থা থেকে প্রতিটি দুর্যোগেই পীড়িত, অনাহারী মানুষের জন্য জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা করে আসছে।

২. ন্যূনতম খাদ্য সংস্থান কর্মসূচিঃ দেশের দরিদ্র, অবহেলিত, দুর্যোগকবলিত মানুষের জন্য ন্যূনতম খাদ্য সংস্থানের ক্ষেত্রে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি বেশ তৎপরতা দেখায়। বাংলাদেশ এটি ৭ লক্ষ অবাঙালিদের জন্য ২০০ মেট্রিকটন খাদ্য বণ্টন করে থাকে। এ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হচ্ছে দুঃস্থ, অসহায়, পরিবারগুলোর মধ্যে খাদ্য ও শিশু খাদ্য সাপ্তাহিক ভিত্তিতে বিতরণ করা।

৩. জরুরি-চিকিৎসা কর্মসূচিঃ রেড ক্রিসেন্ট দুঃস্থ, গরিব আহত রোগীদের জরুরি চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকে। এ লক্ষ্যে এটি ৭টি ভ্রাম্যমাণ ইউনিট এবং ৫০ শয্যাবিশিষ্ট ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়াও উক্ত কর্মসূচির উন্নয়নে আরো কিছু চিকিৎসাকেন্দ্র খোলার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

৪. রক্তদান কর্মসূচিঃ এ সোসাইটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হচ্ছে রক্তদান কর্মসূচি। রক্ত দিন জীবন বাঁচান এই শ্লোগানকে সামনে রেখে এ কর্মসূচি সারাদেশে পরিচালিত হচ্ছে।

৫. স্বাস্থ্য কর্মসূচিঃ বাংলাদেশের আপামর জনগণের স্বাস্থ্যরক্ষা, রোগপ্রতিরোধ ও নিরাময়ের জন্য এ সোসাইটি বিভিন্ন কার্যক্রম করে থাকে। ঢাকায় হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল ও হাসপাতাল সংলগ্ন নার্সিং স্কুলটিও এ সোসাইটির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। তাছাড়াও এ সোসাইটি সমাজের দরিদ্র অসহায় জনগণকে পুষ্টিজ্ঞান দান, পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণ প্রভৃতি কাজ করে যাচ্ছে।

৬. ধাত্রীবিদ্যা ও ধাই প্রশিক্ষণ কর্মসূচিঃ নিরাপদ প্রসূতি সেবাদানে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি এ কর্মসূচির পরিচালনা করছে। এর আওতায় ঢাকার বাংলাবাজার রেডক্রস মাতৃসদন, সিলেটের মাতৃসদন ও চট্টগ্রামের জ্যামসের মাতৃসদন স্থাপন করা হয়। এ গুলোতে ধাত্রী ও ধাইদের আধুনিক প্রশিক্ষণের সার্বিক ব্যবস্থা গৃহীত হয়ে থাকে।

৭. মাতৃমঙ্গল ও শিশুকল্যাণ কর্মসূচিঃ মা ও শিশুর কল্যাণ নিশ্চিতে রেডক্রিসেন্ট সারাদেশে ২১টি মাতৃসদন ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রের মাধ্যমে হাজার হাজার শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের সেবাদান করছে।

৮. এ্যাম্বুলেন্স কর্মসূচিঃ রোগীদের নিরাপদ পরিবহনের লক্ষ্যে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি এ্যাম্বুলেন্স কর্মসূচি পরিচালনা করছে। এর ৪২টি এ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে হাসপাতালগুলোয় ব্যবহৃত হয় ১৮টি, তাকে ১৪টি রেডক্রস শাখাগুলো ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা ইউনিট হিসেবে কাজ করে।

৯. প্রাক-দুর্যোগ পাইলট প্রকল্প: উপকূলীয় এলাকার জনগণ যাতে দুর্যোগে আশ্রয় লাভ করতে পারে সেই লক্ষ্যে এই পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ১৯৬৯ সালে কক্সবাজারে ১০ সি. এম. একটি রাডার কেন্দ্রের স্থাপনের মাধ্যমে এ কাজ আরো সম্প্রসারিত হয়।

১০. এতিম ও অসহায় শিশুদের পুনর্বাসন কর্মসূচিঃ এতিম ও অসহায় শিশুদের মঙ্গলার্থে এর আওতায় একটি এতিমখানা পরিচালিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরো ৮টি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করতে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

রেডক্রস সোসাইটির নাম পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়াঃ রেডক্রস সোসাইটির নাম পরিবর্তন করে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি রাখার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:

বাংলাদেশ সরকার ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণার পর বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির নাম পরিবর্তন করে রেডক্রিসেন্ট রাখা হয়। রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি রাখার পর এর কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এর সেবা পেতে থাকে। সবারই মনে এর সেবা পাওয়ার অধিকার জন্ম নেয়। বাংলাদেশে রেডক্রিসেন্টের জন্ম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুর্কী সুলতান খ্রিস্টানদের প্রতি বিরোধিতার প্রশ্নে রেডক্রসের পরিবর্তে রেডক্রিসেন্ট নাম ব্যবহার করতে থাকেন। রেডক্রিসেন্ট মূলত খ্রিস্টান ও মুসলমান বৈরিতার সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে মুসলিম দেশগুলো রেডক্রসের পরিবর্তে রেডক্রিসেন্ট নাম ব্যবহার করতে থাকেন। বাংলাদেশ ১৯৮৮ সালের এপ্রিল মাসে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশবলে এর নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি’ রাখা হয়। ফলশ্রুতিতে এদেশে আন্তর্জাতিক সাহায্যের পরিমাণ অনেকটা কমে যায়। কারণ খ্রিস্টান সম্প্রদায় যারা আন্তর্জাতিক রেডক্রসের অর্থ যোগানদাতা এবং পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে সদা নিয়োজিত তারা বাংলাদেশে পরিকল্পনামাফিক সাহায্যদানের মাত্রা কমিয়ে দেয়। কয়েকটি মুসলিম দেশ ব্যতীত সারাবিশ্বে রেডক্রস নামের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। নাম বড় নয় সেবামূলক কার্যক্রমটাও বড়। তাই নামের বৈরিতা ত্যাগ করে সর্বধর্মের সব শ্রেণির কল্যাণে এ সোসাইটি কাজকে প্রসারিত করতে হবে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত। রেডক্রস রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির নামে এদেশে পরিচালিত হলেও সেবার মানে কোনো তারতম্য ঘটেনি। নিত্যদিন এই সোসাইটির কর্মসূচি বেড়েই চলেছে। তাই বাংলাদেশে রেডক্রস সোসাইটির গুরুত্ব অত্যধিক।