লর্ড উইলিয়াম বেন্টিষ্কের প্রশাসনিক ও সামাজিক সংস্কারসমূহ পর্যালোচনা কর।

অথবা, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিষ্কের প্রশাসনিক ও সামাজিক সংস্কারসমূহ উল্লেখপূর্বক ব্যাখ্যা কর।

অথবা, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের প্রশাসনিক ও সামাজিক সংস্কারসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দাও।

উত্তর : ভূমিকা: ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিষ্কের শাসনকাল একটি গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে। লর্ড বেন্টিষ্কের পূর্বে ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন: প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম ও অসামঞ্জস্যতা বিরাজিত থাকায় ভারতীয় সমাজজীবন অনেকটা বিষিয়ে উঠে। তিনি এক উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমাজের এ সকল অসামঞ্জস্য দূরীকরণের জন্য ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করে ভারতীয় সমাজে এক জাগরণ সৃষ্টি করেন। বস্তুত তার সামগ্রিক সংস্কার ও কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ভারতীয় সমাজের স্থিতিশীলতা আসে।

বেন্টিষ্কের গভর্নর জেনারেল পদ: লর্ড আর্মহাস্টের স্বেচ্ছায় পদত্যাগের পর ১৮২৮ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ভারতের গভর্নর জেনারেল পদে নিযুক্ত হন। তিনি ১৮২৮-১৮৩৫ সাল পর্যন্ত ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

প্রশাসনিক সংস্কার : নিম্নে প্রশাসনিক সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

১. ফৌজদারি মামলার দায়িত্ব: কর্নওয়ালিশ কর্তৃক প্রবর্তিত ভ্রাম্যমান আদালতগুলো এবং প্রাদেশিক আপিল আদালতগুলো বেন্টিঙ্ক বাতিল করেন। তিনি ফৌজদারি মামলার দায়িত্ব জেলার বিচারকদের উপর ন্যস্ত করেন এবং কালেক্টরদের ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রদান করেন।

২. কমিশনার পদ সৃষ্টি : কয়েকটি জেলা নিয়ে একটি ডিভিশন বা বিভাগ গঠন করেন। প্রতিটি বিভাগে কমিশনার নামে এক নতুন পদের সৃষ্টি করেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, জজ ও পুলিশের কাজের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব কমিশনারের উপর ন্যস্ত করা হয়। প্রাদেশিক আপিল আদালতগুলো সুপারিনটেনডেন্টের পদগুলো বিলুপ্ত করে তাদের ক্ষমতা কমিশনারের হস্তে অর্পণ করা হয়।

৩. চাকরিতে ভারতীয়দের নিয়োগ: বেন্টিঙ্ক ভারতীয়দের কর্মদক্ষতা অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। বেন্টিঙ্ক সর্বপ্রথম ভারতীয়দের বিচার ও শাসন বিভাগের উচ্চপদে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। তিনি ভারতীয়দের মধ্যে সাব-জজ পদের সৃষ্টি করেন। ফারসি ভাষার পরিবর্তে তিনি আদালতে দেশীয় ভাষার প্রচলন করেন।

৪. জুরি ব্যবস্থার প্রবর্তন: লর্ড বেন্টিঙ্কই সর্বপ্রথম ১৮৩২ সালে জুরি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন এবং সেখানে ভারতীয়দের নিয়োগদানের ব্যবস্থা করেন। তাছাড়া তার সময় থেকেই আইন লিপিবদ্ধ হতে শুরু করে এবং কলকাতায় একটি আইন কমিশন স্থাপিত হয়।

সামাজিক সংস্কার: লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সামাজিক সংস্কারসমূহ নিম্নরূপ:

১. সতীদাহ প্রথার বিলোপ: লর্ড বেন্টিঙ্ক ভারতীয় সমাজব্যবস্থা থেকে কুখ্যাত সতীদাহ প্রথার বিলোপ সাধন করে ইতিহাসে সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। বহুকাল থেকেই – হিন্দুসমাজে সহমরণ ও অনুসরণ প্রথার প্রচলন ছিল। তিনি ১৮২৯ সালে এর বিলোপ করেন।

২. ঠগী দমন: ঠগী দমন বেন্টিঙ্কের আর একটি উল্লেখযোগ্য সমাজ সংস্কার। মুঘলদের পতনযুগে ঠগী নামে এ দস্যুদল ভারতের সর্বত্র ত্রাসের সৃষ্টি করে। এরা ছদ্মবেশে – তীর্থযাত্রা ও পথিকদের অনুসরণ করত এবং সুযোগ পেলেই – তাদের গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করে সর্বস্ব লুণ্ঠন করত। লর্ড বেন্টিঙ্ক ঠগী দমন করার জন্য শ্লীম্যান এর উপর দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। ১৮৩০ সালে শ্রীম্যান ঠগীদের কঠোর হস্তে দমন করে -কৃতিত্বের পরিচয় দেন।

৩. গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন নিষিদ্ধ: তৎকালীন হিন্দুরীতি অনুযায়ী দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য প্রথম সন্তানকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করা হতো। বেন্টিঙ্ক এ অমানবিক প্রথা সম্পূর্ণরূপে – নিষিদ্ধ করেন। ফলে সমাজের মধ্যে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষিত হয়।

৪. কন্যাসন্তান হত্যা নিষিদ্ধ : অনেকটা প্রাক-ইসলামি যুগের আরব দেশের ন্যায় উনিশ শতকে ভারতবর্ষের লোকেরাও’ কন্যাসন্তানকে হত্যার মতো নিষ্ঠুর কাজে লিপ্ত হয়। বেন্টিঙ্ক এ অমানবিক প্রথা নিষিদ্ধ করেন।

৫. নরবলি নিষিদ্ধকরণ: তৎকালীন ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে দেবতার সন্তুষ্টির জন্য নরবলি দেয়া হতো। লর্ড বেন্টিঙ্ক এ ধরনের অমানবিক রীতি প্রথা নিষিদ্ধ করে কঠোর আইন জারি করেন। তিনি আইন অমান্যকারীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে লর্ড বেন্টিঙ্কই একমাত্র শাসক, যিনি ভারতবাসীর বিভিন্ন সমস্যা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আর এ উপলব্ধি থেকেই তিনি বিভিন্ন সংস্কারমূলক কাজ সাধন করেছেন এবং ভারতবাসীর কল্যাণসাধন করেছেন। তাই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এক গৌরবোজ্জ্বল স্থান অধিকার করে আছেন।