লর্ড উইলিয়াম বেস্টিকের সামাজিক ও শিক্ষা বিষয়ক সংস্কারসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিষ্কের সামাজিক ও শিক্ষাসংস্কার আলোচনা কর।

অথবা, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সামাজিক ও শিক্ষাসংস্কার সম্পর্কে কী জান? ব্যাখ্যা কর।

অথবা, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিষ্কের সামাজিক ও শিক্ষাসংস্কার সম্বন্ধে সম্যাখভাবে ব্যক্ত কর।

উত্তর: ভূমিকা: প্রথম জীবনে মাদ্রাজের গভর্নর হিসেবে অভিজ্ঞ লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। তার শাসনকাল যুদ্ধ বিগ্রহের জন্য নয়, শান্তি ও সংস্কারের জন্যই ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সংযোজন করেছে। ঐতিহাসিক ভি.ডি. মহাজন বলেছেন, তিনিই ছিলেন প্রথম গভর্নর জেনারেল যিনি এ মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন যে, ভারতীয় জনগণের মঙ্গল সাধনই ব্রিটিশ সরকারের মূল কর্তব্য হওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন। তিনি বিজয় অভিযানের জন্য নহে, বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুবিধ সংস্কার প্রবর্তনের জন্য ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন।

বেন্টিঙ্কের সামাজিক ও শিক্ষাবিষয়ক সংস্কারসমূহ: লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সামাজিক ও শিক্ষা বিষয়ক সংস্কারসমূহ আলাদা আলাদাভাবে নিম্নে আলোচনা করা হলো:

সামাজিক সংস্কার: লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সামজিক সংস্কারসমূহ নিম্নরূপ:

১. সতীদাহ প্রথার বিলোপ: সমাজ সংস্কারক হিসেবে তিনি সমধিক খ্যাতি অর্জন করেন। সম্রাট আকবর, লর্ড মিন্টো, কর্নওয়ালিশ, হেস্টিংস প্রমুখ সকলেই হিন্দুসমাজে প্রচলিত সহমরণ ও অনুসরণ প্রথা বন্ধ করতে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু কেউই এ ব্যাপারে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হননি। অতঃপর লর্ড বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা রহিত করেন এবং বলপূর্বক বিধবাদের সহমরণে বাধ্য করাকে আইনত দণ্ডনীয় বলে এক আইন জারি করেন।

২. ঠগীদের দমন : মুঘল সম্রাট আকবরের সময় হতে শুরু করে কোম্পানির আমল পর্যন্ত ঠগীরা ভারতবর্ষে সর্বত্র খুন, রাহাজানি দ্বারা ত্রাসের সৃষ্টি করে। অতর্কিত আক্রমণে পথিকদের গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করে তাদের অর্থ ও জিনিসপত্রাদি আত্মসাৎ করাই ছিল ঠগীদের উপজীবিকা। বেন্টিঙ্ক কর্নেল শ্লাম্যানকে ঠগী দমনের ভার অর্পণ করলে তিনি ফিরিঙ্গিয়া নামক জনৈক ঠগীর নিকট হতে ঠগীদের গোপন ঘাঁটি সম্পর্কে সংবাদ এ সংগ্রহ করে কাঠোর হস্তে ১৮৩০ সালে তাদেরকে দমন করেন।

৩. গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন নিষিদ্ধ: তৎকালীন হিন্দুসমাজের । কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকজন তাদের প্রথম সন্তানকে পুণ্যার্থে গঙ্গায় ন বিসর্জন দিত। বেন্টিঙ্ক এ অমানবিক প্রথা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেন। এমনকি নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান করেন। ফলে সমাজ থেকে গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন প্রথা দূরীভূত হয়।

৪. কন্যাসন্তান হত্যা নিষিদ্ধ : অনেকটা প্রাক-ইসলামি যুগের আরব দেশের ন্যায় উনিশ শতকে ভারতবর্ষের লোকেরাও কন্যা সন্তানকে হত্যার মতো নিষ্ঠুর কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। বেন্টিঙ্ক এ অমানবিক প্রথা নিষিদ্ধ করে আইন পাস করেন।

৫. নরবলি নিষিদ্ধ: তৎকালীন ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে দেবতার সন্তুষ্টির জন্য নরবলি দেয়া হতো। লর্ড বেন্টিঙ্ক এ ধরনের অমানবিক রীতি প্রথা নিষিদ্ধ করে কঠোর আইন জারি করেন। তিনি আইন অমান্যকারীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেন।

শিক্ষা সংস্কার: লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শিক্ষা সংস্কারসমূহ নিম্নরূপ:

১. পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন: পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন লর্ড বেন্টিষ্কের অন্যতম শ্রেষ্ঠকীর্তি। ১৮১৩ সালের সনদ অনুসারে কোম্পানি ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য বাৎসরিক কমপক্ষে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করতে বাধ্য ছিল। এই অর্থ কেবল সংস্কৃত ও ফারসি প্রভৃতি প্রাচ্য ভাষা শিক্ষার জন্যে ব্যয় করা হতো। তিনি ১৮৩৩ = সালে এই অর্থ পাশ্চাত্য শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেন।

২. মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা: ১৮৩৫ সালে লর্ড বেন্টিঙ্কের চেষ্টায় কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও বোম্বাই এর এলফিন স্টোন ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হয়। তার ঐকান্তিক চেষ্টায় ভারতবর্ষে ১ পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার অবাধ প্রসারের পথ উন্মুক্ত হয়।

৩. এ্যাডামস কমিটি গঠন : বড় লাট উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তদন্ত করে রিপোর্টদানের জন্য ১৮৩৫ সালে এ্যাডামস কমিটি গঠন করেন।

৪. ফিলট্রেশন তত্ত্ব গ্রহণ : বেন্টিঙ্ক ও ম্যাকলে গণশিক্ষার জন্য ব্যাপক স্কুল প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি। শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি অর্থের বরাদ্দ এতই কম ছিল যে, ব্যাপক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল না। এজন্য বেন্টিঙ্ক ফিলট্রেশন তত্ত্ব গ্রহণ করেন। অর্থাৎ ফিল্টারের জল যেমন উপর থেকে নিচে নামে সেরূপ উপরের তলার শিক্ষিত লোকেরা নিচের তলার লোকদের কাছে গিয়ে তাদের ইংরেজি শিক্ষা দিবে। বেন্টিষ্কের এ নীতির ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটে।

৫. ইংরেজি মিশনারিক শিক্ষা চালু: বেন্টিঙ্ক ইংরেজি শিক্ষাকে সরকারের শিক্ষানীতি হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষপাতী ছিলেন। ১৮২৯ সালে তিনি ইংরেজি শিক্ষার অনুকূলে মত দেন। তার ইতিবাচক মনোভাবের কারণে ১৮৩০ সালে স্কটিশ মিশনারির রেভারেন্ড আলেকজান্ডার ডাফ কলকাতায় আসার পর মিশনারিদের প্রচেষ্টায় ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারে গতি সঞ্চারিত হয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, লর্ড হেস্টিংসের শাসনামল যেমন যুদ্ধের ক্ষেত্রে বিজয় অর্জনের জন্য বিখ্যাত ছিল ঠিক তেমনি লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শাসনামল শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য মশহুর ছিল। ভারতবাসীর মানসিক ও নৈতিক উন্নতির চেষ্টা করে তিনি সামগ্রিকভাবে ভারতীয় সমাজের অশেষ কল্যাণ সাধন করেন। ফলে ভারতবাসী আজ তার নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।