অথবা, দ্বৈতশাসন বলতে কি বুঝ? বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে এর প্রভাব আলোচনা কর।
অথবা, দ্বৈতশাসন কী? বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে এর ফলাফল উল্লেখ কর।
উত্তর: ভূমিকা: রবার্ট ক্লাইভ দ্বিতীয়বার গভর্নর হিসেবে বাংলায় এসে যে শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন তা দ্বৈতশাসন নামে পরিচিত। বাংলা তথা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে দেওয়ানি লাভ একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভ মূলত দ্বৈতশাসনের সূচনা করে এবং এ সনদ প্রাপ্তি বাংলায় অর্থনৈতিক ও তার প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের সনদ বলা যেতে পারে। ক্লাইভ প্রবর্তিত দ্বৈতশাসন ১৭৬৫ থেকে ১৭৭২ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা : দেওয়ানি লাভের পর ক্লাইভ বাংলায় দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এ নতুন ব্যবস্থা অনুযায়ী নবাবের দায়িত্ব ছিল বিচার ও শাসনকার্য পরিচালনা: কোম্পানিকে দেয়া হলো রাজস্ব আদায় ও দেশরক্ষার ভার। কোম্পানি ছিল একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায়ে মুনাফা অজর্নই ছিল এর প্রধান লক্ষ্য। এজন্য প্রথমদিকে শাসন-দায়িত্ব এড়িয়ে ক্লাইভ রাজস্বের ভার গ্রহণ করেন। কিন্তু পরে নানা অসুবিধার জন্য এক অতিরিক্ত মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সরাসরি নিজে না নিয়ে তিনি এদেশের অভিজ্ঞ লোকের উপর ন্যস্ত করেন। বাংলা ও বিহারের জন্য সৈয়দ মুহাম্মদ রেজা খাঁন ও সেতাব রায় নামে দুই ব্যক্তিকে নায়েব নাজিম নিযুক্ত করা হলো। তারা রাজস্ব আদায় ও কোম্পানির স্বার্থ দেখাশোনা করতেন। দেওয়ানী গ্রহণ করে ও প্রত্যক্ষভাবে দেওয়ানী সংক্রান্ত দায়িত্ব না নেওয়ার কারণ সম্বন্ধে ক্লাইভনিজেই বলেছেন যে, “সেই সময় ইংরেজ কোম্পানি দেওয়ানীর কার্যাদি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ছিল।”
বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে দ্বৈতশাসন ব্যবস্থার প্রভাব: নিম্নে বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে দ্বৈতশাসনের প্রভাব পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করা হলো:
(ক) রাজনৈতিক জীবনে দ্বৈতশাসনের প্রভাব: রাজনৈতিক জীবনে দ্বৈতশাসনের প্রভাব ছিল অপরিসীম। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. নবাবের ক্ষমতাহীন দায়িত্ব : ক্লাইভের প্রবর্তিত দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা এদেশবাসীর জন্য এক বিরাট অভিশাপ ছিল। এ ব্যবস্থা অনুযায়ী নবাবের দায়িত্ব ছিল, কিন্তু কোনো ক্ষমতা ছিল না। অর্থের জন্য তাকে কোম্পানির দয়ার উপর নির্ভর করতে হয়। ফলে প্রয়োজনের সময় ক্ষমতা ও অর্থের অভাবে নবাব কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন না।
২. প্রশাসনিক জটিলতা বৃদ্ধি : বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব কোম্পানির হাতে ন্যস্ত হওয়ায়
কোম্পানির ফ্যাক্টর ও বণিকরা রাতারাতি প্রশাসকে পরিণত হয়। এসব প্রশাসকের ভারতীয় রাজস্ব রীতিনীতি সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকায় তারা ইংল্যান্ডের রীতিনীতি ভারতে প্রয়োগ করতে থাকেন। ফলশ্রুতিতে প্রশাসনিক জটিলতা বৃদ্ধি পায়।
৩. শাসনের নামে অপশাসন : নিজামত ও কোম্পানির কর্মচারীরা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তারা রাজ্য শাসনের নামে কুশাসন করে।
৪. দুর্নীতির ব্যাপকতা: পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে দেশের সম্পদ হ্রাস পেতে থাকে, কিন্তু রাজস্বের হার প্রতি বছরই বাড়তে থাকে। ঐতিহাসিক কেরী মন্তব্য করেন যে, দ্বৈতশাসনের ফলে বাংলায় অরাজকতা ও দুর্নীতি চরমভাবে আত্মপ্রকাশ করে।
৫. কোম্পানির নিজস্ব মত প্রতিষ্ঠা: ক্লাইভ প্রবর্তিত যী দ্বৈতশাসন বাংলায় কোম্পানির প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে। কেননা রাজ্যের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব কোম্পানির সেনাবাহিনী ও রাজ্যের রাজনৈতিক প্রভৃত্ব কোম্পানির কর্মচারীদের হাতে চলে যায়। তাছাড়া বৈদেশিক নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য নবাবকে কোম্পানির সাহায্যের উপর নির্ভরশীল করে রাখা হয়।
(খ) অর্থনৈতিক জীবনে প্রভাব: বাংলার অর্থনৈতিক জীবনে দ্বৈতশাসনের প্রভাব সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. রায়তদের দুর্দশা: এ ব্যবস্থার ফলে একদিকে শস্য-পণ্য ও উৎপাদনকারীদের স্বল্পমূল্যে তা যেমন বিক্রয় করতে বাধ্য হয়, অন্যদিকে আবার তাদের কাছ থেকে উচ্চ হারে রাজস্ব দাবি করতো। এই দুই চাপে পড়ে রায়তদের নাভিশ্বাস উঠেছিল।
২. বাংলার অবনতি: দ্বৈতশাসন ব্যবস্থার ফলে বাংলার অর্থনীতি যে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয় রেজা খানের বক্তব্যেই তা স্পষ্ট হয়। রাজস্ব বকেয়া এবং অর্থনৈতিক অবনতির জন্য কোম্পানির কর্তৃপক্ষ রেজা খানকে দায়ী করলে তিনি এক পত্রে কোম্পানিকে জানান যে, এর জন্য দায়ী কোম্পানি, রেজা খান নয়। কেবল তা নয় বাংলার তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট বেচার কোম্পানির পরিচালক সভায় প্রেরিত এক স্মারক লিপিতে স্পষ্টভাবে জানান যে, কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানী লাভের পরে বাংলার অবস্থা নিকৃষ্ট হতে থাকে।
৩. রেশম শিল্পের ধস: দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার ফলে রেশম – শিল্পের ক্ষতি হয়। ইংল্যান্ডের বেশি দামের রেশম বস্ত্র শিল্পকে বাংলার প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করার জন্য ব্রিটিশ সরকার – বাংলায় কেনা সস্তা দামের মুর্শিদাবাদী রেশমের কাপড় ইংল্যান্ডে আমদানি নিষিদ্ধ করেন।
৪. তাঁতিদের দূরবস্থা: এ ব্যবস্থার ফলে রায়তদের দুর্দশা হয় বটে পাশাপাশি তাঁতিদের অবস্থাও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। তাঁতিদের বলপূর্বক আগাম মূল্য নিতে বাধ্য করা হতো। ফলে তাঁতিদের দুর্দশার সীমা ছিল না।
৫. ছিয়াত্তরের মন্বন্তর: কোম্পানির কর্মচারীদের অর্থ লোভ ও অবাধ লুন্ঠন এবং নায়েব নাজিম রেজা খানের দুর্নীতি ও কুশাসন বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সৃষ্টি করেছিল। ১৭৭০ সালে বাংলায় সংঘটিত মন্বন্তরে জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মৃত্যু মুখে পতিত হয়। বাংলার মানুষের দুঃখ-কষ্ট শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। ১৭৭০ সালে অনাবৃষ্টির কারণে চালের মূল্য বৃদ্ধি পায়। ফলে বাংলায় এক চরম বিপর্যয় দেখা দেয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, রবার্ট ক্লাইভ প্রবর্তিত দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা ছিল বাংলার জনসাধারণের জন্য চরম অভিশাপস্বরূপ। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় নৃপতিদের প্রতি জনসাধারণের মতের পরিবর্তন ঘটানো এবং কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের নিশ্চয়তা বিধান করা। দ্বৈত শাসন সম্পর্কে মহাজন বলেন, “দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা ছিল সামরিক, ১৭৬৫ সালে ইংরেজগণ যে সমস্যার সম্মুখীন হয় তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এটি ছিল একটি তাৎক্ষণিক চুক্তি।”