অথবা, লর্ড ডালহৌসির শাসনতান্ত্রিক সংস্কারসমূহ সম্পর্কে বিবরণ দাও।
অথবা, লর্ড ডালহৌসির শাসনতান্ত্রিক সংস্কারসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য ব্রিটিশ ভারতের যে কয়জন গভর্নর জেনারেল বিখ্যাত হয়ে আছেন তন্মেধ্যে লর্ড ডালহৌসির নাম সবার শীর্ষে। ঘোর সাম্রাজ্যবাদী হলেও তার সংস্কার কার্যাবলি আধুনিক ভারতবর্ষের ভিত্তি স্থাপনে সহায়ক ছিল। বস্তুত তিনি সাম্রাজ্য বিস্তার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইম্পিরিয়াল শক্তির মর্যাদাকে অতুচ্চে প্রতিষ্ঠিত করেন।
লর্ড ডালহৌসির শাসনতান্ত্রিক সংস্কার: গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির শাসনতান্ত্রিক সংস্কারসমূহ নিম্নে
আলোচনা করা হলো:
১. গভর্নর নিয়োগ : তিনি বঙ্গদেশের জন্য একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিযুক্ত করেন। পাঞ্জাব এবং বার্মার পেগু প্রদেশেও তিনি একটি সুন্দর শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এতে গভর্নর জেনারেলের কাজের চাপ হ্রাস পায়।
২. কেন্দ্রীয় শাসন পরিষদ গঠন: তিনি কেন্দ্রীয় শাসন পরিষদ স্থাপন করেন এবং এতে ভারত সরকার এর সর্বময় কর্তৃত্ব থাকলেও স্থানীয় সরকারকেও অংশ গ্রহণের জন্য আহ্বান করা হত। এতে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ সরকার আইনসম্মতভাবে সর্বময় কর্তৃত্ব, ভোগ করলেও স্থানীয় সরকারকে এতে অংশগ্রহনের সযোগ সৃষ্টি করা হয়।
৩. জেলায় বিভক্ত করণ: তিনি সমগ্র ব্রিটিশ ভারতকে জেলায় বিভক্ত করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সব ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল। এতে জেলা ভিত্তিক রাজকর্মচারীদের দায়-দায়িত্ব অনেক গুণে বৃদ্ধি পায়। এতে শাসন কার্যে গতিশীলতা সৃষ্টি হয়।
৪. সেনাবাহিনী গঠন: তিনি গুর্খা সেনাবাহিনী গঠন করেন এবং পুরাতন শিখ বাহিনীকে ভেঙ্গে দেন। তিনি পাঞ্জাব ফ্রন্টিয়ার ফোর্স গঠন করেন। তিনি এই উপমহাদেশে ভবিষ্যতে যে-কোনো বিদ্রোহ দমন করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। বাঙালি সিপাহীদের বিদ্রোহের আশঙ্ক্ষা থাকায় তিনি
তাদেরকে কলকাতা হতে মীরাটে স্থানান্তরিত করেন।
সামাজিক সংস্কার : উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে তার সামাজিক সংস্কারসমূহ নিম্নরূপ:
১. হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহের অধিকার প্রদান: লর্ড ডালহৌসির সমাজ সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে একটি অন্যতম কাজ হলো বিধবা বিবাহের অনুমোদন। তিনি বিধবা বিবাহ আইন পাস করে হিন্দু বিধবা বিবাহকে আইনসঙ্গত করেন।
২. রেলপথ স্থাপন: লর্ড ডালহৌসি প্রথম গভর্নর জেনারেল যিনি ভারতে রেলপথ স্থাপন করেন। এটা স্থাপিত হয় ১৮৫৩ সালে। প্রথমে বোম্বাই থেকে থানা পর্যন্ত ও পরে কলকাতা থেকে রাণিগঞ্জ এলাকার মধ্যে রেল চালু হয়।
৩. গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের পুনঃনির্মাণ: আফগান নেতা শেরশাহের সময়ে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের নির্মাণ শুরু হয়। লর্ড ডালহৌসি সেই রোডের নির্মাণে সমাপ্তি ঘটান। এতে করে ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়।
৪. ডাক বিভাগ: লর্ড ডালহৌসি দেশ ব্যাপী অর্ধআনা মূল্যের ডাক সরবরাহ করার ব্যবস্থা চালু করেন। তার পূর্বে দূরত্ব বুঝে ডাক সরবরাহ খরচ আদায় করা হতো।
শিক্ষা সংস্কার: ডালহৌসি ভারতে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে এর উন্নতিকল্পে মনোনিবেশ করেন্ নিম্নে ডালহৌসির শিক্ষা ক্ষেত্রে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. শিক্ষা বিষয়ক নির্দেশপত্র প্রণয়ন: স্যার চার্লস উড’ শিক্ষা বিষয়ক নির্দেশপত্র নামে একটি পরিকল্পনা ১৮৫৪ সালে প্রস্তুত করেন। শিক্ষা বিষয়ক নির্দেশপত্র আধুনিক ভারতের শিক্ষার অগ্রগতিতে একটি বিরাট পদক্ষেপ ছিল। এই নির্দেশ অনুসারে লর্ড ডালহৌসি শিক্ষা বিভাগ সৃষ্টি করেন এবং তার চেষ্টায় বিভিন্ন স্থানে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
২. বেথুন কলেজ প্রতিষ্ঠা: তার ঐকান্তিক চেষ্টায় বেথুন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। যা আজও ভারতীয় উপমহাদেশে জ্ঞান বিস্তারে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। তিনিই সর্বপ্রথম জনসাধারণের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা করেন।
৩. সরকারি অনুদান প্রদান: লর্ড ডালহৌসি শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযোজনীয় ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্যে সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করেন এবং তিনি নারী শিক্ষারও পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, লর্ড ডালহৌসি তার আট বছরের শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশের শাসনব্যবস্থা সংস্কার সাধন করে আধুনিক যুগের সূচনা করেন। ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ শাসন ও বিচার ব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্য রীতিনীতির প্রবর্তন করেন। সংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি তার পূর্বসূরি বেন্টিংক এবং উত্তরসূরি লর্ড কার্জনের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।