অথবা, ১৯৪০ সালের উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব আলোচনা কর।
অথবা, ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে লাহোর প্রস্তাবের প্রভাব আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে কয়টি ঘটনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে একটি ঘটনা হচ্ছে ১৯৪০ সালে উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাব। সার্বিক দিক থেকে বিবেচনা করলে লাহোর প্রস্তাব ভারতের অন্যান্য বড় বড় রাজনৈতিক ঘটনাগুলোকে একদিক থেকে ছাড়িয়ে যায়। কেননা লাহোর প্রস্তাবই হচ্ছে একমাত্র প্রস্তাব যেখানে মুসলমানরা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে সর্বপ্রথম পৃথক আবাস ভূমির দাবি তুলে। এতদিন পর্যন্ত ভারতে যে সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল তা ছিল মোটামুটি হিন্দু ও মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধতার ভিত্তিতে রচিত। লাহোর প্রস্তাব এই ঐক্যবদ্ধতাকে ছিন্ন করে দেয়।
লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব: ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৪০ সালে উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সকল দিক থেকে লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব অত্যাধিক। কেননা লাহোর প্রস্তাব পরবর্তীতে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাববিস্তার করে। নিম্নে লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো:
১. রাজনীতিতে নতুন ধারা: ১৯৪০ সালে উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাব ভারতবর্ষের রাজনীতিতে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করে। এতদিন ভারতবর্ষের রাজনীতিতে দুটি রাজনৈতিক দল থাকলেও সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হত এক পক্ষীয়ভাবে। কিন্তু লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ভারতের রাজনীতি সমানভাবে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। যার ফলে রাজনীতি নতুনভাবে অগ্রসর হয়।
২. মুসলিম ঐক্যবোধ সৃষ্টি: লাহোর প্রস্তাবের ফলে মুসলিম ঐক্যবোধ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এতদিন হিন্দু ও মুসলমানরা পরস্পর মিলে-মিশে চলত এবং নিজেদেরকে একই জাতীয়তাবোধের অধীন বলে মনে করত। কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের পর মুসলমানরা হিন্দুদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুসলিম ঐক্যবোধের সূত্রে আবদ্ধ হয় এবং ইসলাম ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধ তৈরি করে।
৩. মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি: লাহোর প্রস্তাবের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এতদিন অনেক মুসলমান ও কংগ্রেসের অধীনস্ত ছিল কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের পর মুসলমানদের নিকট ‘কংগ্রেস হিন্দুদের দল’ এরূপ মানসিকতা সৃষ্টি হয়। যার ফলে সকল মুসলমানই মুসলিম লীগের ছায়াতলে আসন নেয়।
৪. ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের প্রভাব: ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে লাহোর প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। কেননা এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ মোট ৪৯২টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৪২৮টি আসন লাভ করে। অথচ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের আগে মুসলিম লীগ ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মাত্র ১০৯টি আসন লাভ করে।
৫. ভারত স্বাধীনতা আইন পাস: লাহোর প্রস্তাবের ফলে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে স্বার্থগত চরম দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যার ফলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যায়। এরূপ অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার অনুধাবন করতে পারে যে, ভারতবর্ষের বিভক্তি ছাড়া সমস্যা সমাধানের আর কোন পথ নেই। তাই লাহোর প্রস্তাবকে কেন্দ্র করেই ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন পাস করা হয়।
৬. পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম: সকল বন্ধনকে ছিন্ন করে ও সমস্ত বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। যার ফলে লাহোর প্রস্তাবে উত্থাপিত মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি বাস্তব রূপ লাভ করে। মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রতা লাভ করে।
৭. নবদিগন্তের সূচনা: ভারতবর্ষের রাজনীতির ইতিহাসে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব এক নব দিগন্তের সূচনা করে। কেননা এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই ভারতবর্ষ তার হাজার বছরের ইতিহাস ছিন্ন করে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর ভারতবর্ষের পিছিয়ে পড়া মুসলমানরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পায়।
৮. স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ বপন: আজকে আমরা যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বসবাস করছি তারও স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয় ১৯৪০ সালে উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবে। কেননা লাহোর প্রস্তাবে যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয় পরবর্তীতে স্বাধীন পাকিস্তানে বাঙালিরা তারই ভিত্তিতে আন্দোলন করে। এবং এই ভিত্তিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা লাভ করেছি একসময় কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
৯. স্বাধীন বাংলার বীজ বপন: লাহোর প্রস্তাবই সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ বপন করেছিল। কেননা লাহোর প্রস্তাবে বলা হয় যে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে। তবে পরবর্তীকালে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একাধিক জায়গায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলা হয়। কিন্তু বাংলার মুসলমানরা সর্বদাই লাহোর প্রস্তাবের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে রেখে আন্দোলন করতে থাকে। নানা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই বলা হয় বাংলার স্বাধীনতা অনেকাংশে লাহোর প্রস্তাবেরই ফল।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৪০ সালে উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা লাহোর প্রস্তাব ভারতের পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেই পরিবর্তন করে ফেলে। এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই ১৯৪৭ সালে মুসলমানরা তাদের প্রাণের দাবি পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম দেয় পরবর্তীতে বাঙালিদের নানা আন্দোলনের প্রেরণাও ছিল এই লাহোর প্রস্তাব।