লাহোর প্রস্তাবের ধারাগুলো কি ছিল? লাহোর প্রস্তাবের ফলে উপমহাদেশে কীরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল?

অথবা, লাহোর প্রস্তাবে উত্থাপিত কোন কোন বৈশিষ্ট্যের আলোকে উপস্থিত হয়। লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনে যে সব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল তা আলোচনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: ভারতীয় উপমহাদেশের স্মরণীয় ইতিহাসের মধ্যে লাহোর প্রস্তাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একটি প্রস্তাবে গৃহীত হয় যা লাহোর প্রস্তাবে নামে পরিচিত। আর এ প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ. কে ফজলুল হক। তিনি জোরালো কণ্ঠে বলেন, “আমি প্রথমে মুসলমান পরে বাঙালি। ১৯০৬ সালে বাংলাদেশেই প্রথম মুসলিম লীগের নিশান উত্তোলিত হয়েছিল। এখন বাংলাদেশের নেতা হিসেবে সেই মুসলিম লীগের মঞ্চ হতে আমি মুসলমানদের জন্য আবাসভূমি উত্থাপন করার অধিকার পেয়েছি’। আর তার এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এটা জাতিগত দিক হিসেবে স্থান পায় এবং অনিবার্য পরিণতিতে ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। নিম্নে প্রশ্ন লোকে আলোচনা যথাযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হলো।
লাহোর প্রস্তাবের ধারা লাহোর প্রস্তাবের উপস্থাপন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হককে শেরে বাংলা উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলীম লীগের অধিবেশনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। তার এ প্রস্তাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোক পাত করা হয়। যা মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

নিম্নে এর ধারাগুলো আলোচনা করা হলো:

অধিবেশনে সুনিশ্চিত অভিমত এই যে, কোনো শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা কার্যকর হবে না বা তা মুসলমানদের কাছে। গ্রহণযোগ্য হবে না যদি তা নিম্নলিখিত মূলনীতি ভিত্তিক না হয়। প্রয়োজন বোধে সীমানার পুনর্বিন্যাস সাধন করতে হবে। প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করলে যে কয়েকটি বিষয় পাওয়া যায় তা হলো-

১. ভৌগোলিক দিক থেকে সংলগ্ন এলাকাগুলোকে প্রয়োজনীয় রদবদলের মাধ্যমে পৃথক অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।

২. এ সকল অঞ্চলের ভৌগোলিক সীমানা প্রয়োজন মত পরিবর্তন করে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের যে সকল স্থানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৩. ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের যে সকল স্থানে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে সেখানে এ স্বাধীন ও স্বাধীন রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য তথা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত প্রদেশ হবে স্বায়ত্তশাসিত।

৪. ভারতের নবগঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর সাথে পরামর্শক্রমে তাদের সাংস্কৃতিক, শাসনতান্ত্রিক ও অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের কার্যকর ব্যবস্থা থাকতে হবে।

৫. আর দেশের যে কোনো ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনায় উক্ত বিষয়গুলো মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করবে।

লাহোর প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া: লাহোর প্রস্তাবে উত্থাপনের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় সম্প্রদায় নানা রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল। কেউ কেউ এটাকে অবান্তর কাজ বলে উল্লেখ করেছেন, আবার কেউ কেউ এটাকে উৎসাহিত করেছেন।ন আর নিম্নে লাহোরে এর মাতা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল তা আলোচনা করা হল।

১. কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া: লাহোর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যে সকল সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো অবস্থান নিয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম কংগ্রেস। ভারতীর হিন্দু কংগ্রেস ও হিন্দু নেতাদের মধ্যে লাহোর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তারা সরাসরি এর বিপরীতমুখী অবস্থান গ্রহণ করে। আর এ প্রস্তবের সমালোচনা করে মহাত্মা গান্ধী বলেন, যদি আমরা শ্রী জিন্নাহর অভিমত গ্রহণ করি তাহলে বাংলাদেশ ও পাঞ্জাবের মুসলমান বা দুটি স্বতন্ত্র ও পৃথক জাতি হয়ে পড়ে। মহাত্মা গান্ধী আরো মন্তব্য করেন ভারত বিভাগকে পাপ কাজের সীমানায় চলে। তিনি বলেন এ আত্মহননের কাজ হতে বিরত থাকতে হবে বলে তিনি জনগণকে আহ্বান করেন।
জওহরলাল এর মন্তব্য- কংগ্রেস সভাপতি জহরলাল নেহেরু মুসলমানদের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন আবাসভূমি গঠনকে অবান্ত র বলে মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, লাহোর প্রস্তাব করে মুসলিম লীগ ভারতে ইউরোপের বলকান অঞ্চলের মতো বহু রাষ্ট্র স্থাপনের দাবি করছে। কংগ্রেস মনে করে মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবি এর অদ্ভুত ও কৃত্রিম দাবি। কংগ্রেস নেতারা মনে করেন ক্ষমতার মোহ ও কংগ্রেসের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য জিন্নাহ পাকিস্তান দাবি উত্থাপন করেছেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই এক জাতিভুক্ত নিদর্শন স্বরূপ কংগ্রেসের মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে ১৯৪০-৪৫ পর্যন্ত কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন করে। কলকাতার হিন্দু পত্রিকাগুলো লাহোর প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করে এবং একে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে আখ্যাকরে হিন্দু নেতারা মনে করেন বাংলাদেশে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে তা তাদের স্বার্থবিরোধি হয়ে দেখা দেবে।

২. ভারতের মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া: ভারতের মুসলমানদের মধ্যে লাহোর প্রস্তাব নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। কেউ এর পক্ষে নেয় আবার কোনো কোনো ভারতীয় মুসলমান এর বিরোধিতা করেন। কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আজাদ এর ঘোরতর বিরোধিতা করেন। মাওলানা আজাদ বলেন আমি একজন ভারতীয় হওয়ায় গর্বিত। আমি ভারতীয় জাতীয়তাবাদে অবিভাজ্য অংশ। আমরা পছন্দ করি বা না করি আমরা এখন একটি ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় জাতিতে পরিণত হয়েছি। আমাদের পৃথক ও বিভক্ত করবার জন্য কোনো দেয়াল অথবা কৃত্রিম পরিকল্পনা এই ঐক্যকে ভাঙতে পারবে না। আর এর বিরোধিরা দিল্লিতে সর্বভারতীয় স্বাধীন মুসলিম কনফারেন্স গঠন করেন। সিন্ধুতে কংগ্রেসের সমর্থনে মূখ্য মন্ত্রী পদে আলীম খান বাহদুর উল্লাহকে সভাপতি করা হয়।

আর সম্মেলনের নাম দেওয়া হয় আজাদ মুসলিম সম্মেলন। লীগের প্রস্তাবিত ভারত বিভক্তিকে কংগ্রেস প্রত্যাখান করে এবং ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারী বলে লীগের দাবিকে ও খণ্ডন করে। মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানীর নেতৃত্বে জমিয়াতুল হিন্দু লাহোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। পাকিস্থান একটি ইসলামী রাষ্ট্র হবে এ মতবাদের তিনি সমালোচনা করেন। তার মতে এর উদ্যোক্তারা কেউ শরিয়ত মানে না। তাহলে এদের দ্বারা কি ভাবে ইসলাম কায়েম হবে। তবে বিরোধিতাকারীরা ছিলেন মুসলমান নেতাদের ক্ষুদ্র অংশ। তখন ভারতের অধিকাংশ মুসলমানদের মধ্যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিই জনপ্রিয়তা লাভ করে।

মাওলানা আজাদের মন্তব্যে পাকিস্তান দাবির প্রবক্তারা ক্ষুব্ধ হন। চৌধুরী খালিকুজ্জামান, একে ফজলুল হক, মাওলানা জাফর আলী, স্যার আব্দুল্লাহ হারুন, নবাব মোহাম্মদ ইসমাইল খান এর সমালোচনা করেন, তারা মাওলানা আজাদের কথাকে মুসলমানদের কথা নয় বলে উল্লেখ করেন এবং একই সাথে টে জিন্নাহর মনোভাবকে ভারতীয় মুসলমানদের মনোভাব বলে মনে করেন।

৩. বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া: লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী প্রাদেশিক স্বায়ত্ত শাসন ও বাংলাদেশের পৃথক রাষ্ট্র সত্তার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় এ,কে, ফজলুল হক মনে করেন, বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা বাঙালি মুসলমানদের হাতে আসবে এবং এ ক্ষমতা নিজেরা ভোগ করবে, কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের হাতে তুলে দেবে না। সোহরাওয়ার্দী মনে করেন, এর ফলে প্রত্যেক প্রদেশ এর উপযোগী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হবে। তিনি আরো বলেন, মুসলিম লীগের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুসলমানরা তাদের প্রদেশে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে তারা এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলবে। বাংলাদেশের মুসলিম লীগের নেতাদের এমনি আশা আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও লাহোর প্রস্তাবের সংঙ্গে দ্বিজাতিতত্ত্ব যুক্ত করায় এবং একে পাকিস্তান প্রস্তাবে হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এর প্রস্তাবকে ফজলুল হক সমর্থন করেননি। কারণ লাহোর প্রস্তাবে দ্বিজাতিতত্ত্ব বা পাকিস্তান শব্দের উল্লেখ ছিল না। যদিও শেষ পর্যন্ত অবাঙালি নেতৃবৃন্দের তৎপরতায় দ্রুত লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তান প্রস্তাব হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এর ফলে মুসলিম লীগের অবাঙালি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বাঙালি নেতৃবৃন্দের দ্বন্দ্ব প্রকট আকার রূপ নেয়। যদিও ভারতীয় উপমহাদেশে কংগ্রেসের একাধিপত্য অবস্থানের লক্ষ্যে মুসলমানরা লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিকে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দেয়। বাংলাদেশের শিক্ষিত মুসলমান ও ছাত্র সমাজের মধ্যে অভূতপূর্ব উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।

৪. ব্রিটিশ সরকারের প্রতিক্রিয়া: ব্রিটিশ সরকার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় ভারতের হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সমর্থন পেতে আগ্রহী ছিলেন। লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের পর ভারত সচিব মন্তব্য করেন, ইংল্যান্ডের কোনো পার্লামেন্ট বা সরকার ভারতের মুসলমানদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো শাসনতন্ত্র চাপিয়ে দেবেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন না। সরকারের এ জাতীয় আশ্বাসে লীগ নেতৃবৃন্দ আশ্বস্ত হয়। পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হলে ভারতের বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা ভয়াবহ রূপ লাভ করে। ব্রিটিশ সরকার লাহোর প্রস্তাবকে আরো গুরুত্বসহ বিবেচনা করে। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে যে, ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায় তথা মুসলিম লীগের সম্মতি ছাড়া ভারতবর্ষে শাসনতান্ত্রিক কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়। লাহোর প্রস্তাবের বিরোধিতাকারী কংগ্রেস ধীরে ধীরে এর গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং পাকিস্তান দাবি মেনে নেয়। পরিশেষে ব্রিটিশ সরকারও চূড়ান্তভাবে উপলব্ধি করতে পারে যে লীগের প্রস্তাব অনুযায়ী ভারত বিভাগ করা না হলে ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের বিকল্প পথ নেই। তাই ব্রিটিশ সরকার অখণ্ড ভারতবর্ষের পরিবর্তে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পথ বেছে নেয়। এর ফলে ভারত উপমহাদেশ দু’ ভাগে বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, লাহোর প্রস্তাব ছিল ভারতীয় মুসলমানদের অধিকার পাওয়ার প্রস্তাব। যদিও এটি পরবর্তীতে পাকিস্তান আন্দোলনকে রূপ নেয়। আর লাহোর প্রস্তাবের পক্ষে অনেকে মত দেন। আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করে। তবে লাহোর প্রস্তাবে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। তারা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য এটাকে পাকিস্তান আন্দোলনে রূপ দান করেন।