লাহোর প্রস্তাব কি পাকিস্তান প্রস্তাব ছিল?

অথবা, লাহোর প্রস্তাব কি মূলত পাকিস্তান প্রস্তাবের অংশ ছিল?

উত্তর: ভূমিকা: ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে লাহোর প্রস্তাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে যে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় তাই লাহোর প্রস্তাব নামে পরিচিত। লাহোর প্রস্তাবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্বায়ত্তশাসন। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এ.কে ফজলুল এই প্রস্তাবটি পেশ করেন। তবে লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তান প্রস্তাব ছিল কিনা এটা একটি গবেষণার বিষয়। তবে লাহোর প্রস্তাবের কোন ধারায় লেখা নেই যে লাহোর প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা।

লাহোর প্রস্তাব কি পাকিস্তান প্রস্তাব কি-না: লাহোর প্রস্তাবে উত্তর পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে ও একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছিল। কোথাও বলা হয়নি স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করবে। তবে পরবর্তীতে যখন পাকিস্তান নামে অধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে তখন অনেকে এ থেকে পাকিস্তান আন্দোলন নামে পরিচিত করার চেষ্টা করে। লাহোর প্রস্তাব কি পাকিস্তান প্রস্তাব কিনা এ বিষয়ে আলোচনা উপস্থাপন করা হলো:

১. পাকিস্তান প্রস্তাব নামে প্রচারণা: লাহোর প্রস্তাবে ভারতবর্ষে উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র’ গঠনের কথা বলা ! হয়েছিল। এ প্রস্তাবের কোথাও একটি মুসলিম রাষ্ট্র কিংবা পাকিস্তান শব্দের উল্লেখ ছিল না। কিন্তু এ প্রস্তাব গ্রহণের পরদিন কংগ্রেস প্রভাবাধীন পত্র পত্রিকাগুলোতে পাকিস্তান প্রস্তাবে শিরোনামে লীগের প্রস্তাবের দাবি দাওয়া প্রকাশ করে। গ্রেট ব্রিটেনের পত্র ! পত্রিকাগুলোতেও পরবর্তী সময়ে “লাহোর প্রস্তাব’ নামে অবহিত করা হয়। তবে কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে লাহোর প্রস্তাব নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কংগ্রেস সমর্থিত পত্র পত্রিকাগুলোতে সমালোচনার জন্যই পাকিস্তান নামে অবহিত করে। কারণ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।

২. পরোক্ষ পাকিস্তান প্রস্তাব: ১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন যে, পাকিস্তান শব্দটি তার বা মুসলিম লীগের উদ্ভাবিত নয়। তিনি বলেন যে সকলেই জানে যে পাকিস্তান শব্দটি কিছু হিন্দু ও ব্রিটিশ পত্রিকা কর্তৃক তাদের ওপর আরোপ করা হয়েছে। তবে তা পাকিস্তান নামেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে বেশি।

জিন্নাহ আরো বলেন যে, কতদিনই বা এত বড় শব্দ ব্যবহার করা যায়। এ জন্য তিনি মাত্র একটি শব্দে প্রস্তাবটি কে অভিহিত করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান। তার অর্থ জিন্নাহর কথায় এটাই বুঝায় যে, প্রস্তাবটি প্রথমে লাহোর প্রস্তাব নামে অভিহিত হলেও তার মনে আসলে অখণ্ড পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল। আর তাই তিনি পত্র-পত্রিকার দোহাই দিয়ে পাকিস্তান প্রস্তাব কথাটিকে সমর্থন করেছেন। এসময় থেকে পাকিস্তান নামটি জনসাধারণের মধ্যে পরিচিত হয়। কিন্তু তখন পাকিস্তান বলতে এক রাষ্ট্র বুঝায়নি। লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী একাধিক রাষ্ট্র বুঝাতো।

৩. একাধিক রাষ্ট্রকরণ: ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত জিন্নাহ লাহোর প্রস্তাব বলতে একাধিক রাষ্ট্রের উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি পাকিস্তান নাম এক রাষ্ট্রের অর্থ ব্যবহার করেন। ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জিন্নাহ ও গান্ধীর মধ্যে যে পত্র বিনিময় হয় তাতে জিন্নাহ প্রথম প্রকাশ করেন যে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠিত হবে। দুই অঞ্চলের প্রদেশগুলো সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে কিনা জিন্নাহর কাছে গান্ধী জানতে চান। উত্তরে গান্ধীকে তিনি জানান যে, প্রদেশগুলো সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে না, এগুলো পাকিস্তানের ইউনিট হবে। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পূর্ব বাংলা ও আসামের প্রয়োজনীয় ভৌগোলিক রদবদল করে এদের সমন্বয়ে পাকিস্তান গঠিত হবে।

৪. জিন্নাহর পরিকল্পনা: জিন্নাহ ১৯৪৫ সালের ৮ নভেম্বর এসোসিয়েটেড প্রেস অব আমেরিকার প্রতিনিধিকে বলেন যে, পাকিস্তান একটি যুক্তরাষ্ট্র হবে এবং এর প্রদেশগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত। আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্র হবে এবং মুদ্রা, জাতীয় প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য বিষয় যুক্তরাষ্ট্রীয় দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারকে দেয়া হবে।

৫. প্রস্তাব সংশোধন: ১৯৪৬ সালে মূল লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে, স্টেটস শব্দের পরিবর্তে স্টেট শব্দ ব্যবহার করার পর থেকে লাহোর প্রস্তাব নামেই অভিহিত হতে থাকে। লাহোর প্রস্তাব এক রাষ্ট্রের অর্থে ব্যবহার করে জিন্নাহ এতে মূলগত পরিবর্তন প্রচলন করেন। এ পরিবর্তনের পেছনে দলীয় কোনো নিয়মতান্ত্রিক সমর্থন ছিল না। তবুও এই প্রস্তাবকে সামনে রেখেই ভারতের মুসলমান জনগণ মুসলিম জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হয়। এর ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।

৬. বিশ্লেষণ/মূল্যায়ন: লাহোর প্রস্তাব প্রথমে মূলত পাকিস্তান প্রস্তাব ছিল না। কেননা লাহোর প্রস্তাব অনুসারে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবে। পরবর্তীতে কংগ্রেসের বিরোধিতা ও বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় সমালোচনার অর্থে লাহোর প্রস্তাবকে পাকিস্তান প্রস্তাব হিসেবে বর্ণনা করে। আর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এখান থেকেই স্বপ্ন দেখেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে। যেহেতু সেই সময় পাকিস্তান শব্দটি জনপ্রিয় ছিল তাই অধিকাংশ জনগণ এর বিরোধিতা করলেও তারা মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়েন। এজন্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ লাহোর প্রস্তাবকে সংশোধন করে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থলে একটি মুসলিম স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেন। যার ধারাবাহিকতাই তিনি ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট ভারত বর্ষ বিভক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। তাই বলতে পারি লাহোর প্রস্তাব ছিল মূলত পাকিস্তান প্রস্তাব।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, লাহোর প্রস্তাব যখন উপস্থাপন করা হয় তখন মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষে মুসলিম যে বৈষম্যের স্বীকার হন তা থেকে মুক্তি। এজন্য এ.কে. ফজলুল হক সকল প্রকার অত্যাচার, অবিচার হতে মুক্তির জন্য পৃথক পৃথক অঞ্চল গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু ভারতীয় কংগ্রেসরা এর ঘোর প্রতিবাদ করে। কেননা তারা ছিল শাসকগোষ্ঠী এবং তারা ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিল। তারা বিরোধিতা করে এটা পাকিস্তানি প্রস্তাব বলে আখ্যায়িত করে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এটাকে পাকিস্তানী প্রস্তাবে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আর তারই পরিপ্রেক্ষিতেই লাহোর প্রস্তাব এর পরিবর্তন হয়ে পাকিস্তান প্রস্তাব বিস্তার লাভ করে, পাকিস্তানী রাষ্ট্র গঠিত হয়।