লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ফলে ভারত বিভক্তি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল আলোচনা কর।

অথবা, তুমি কি মনে কর লাহোর প্রস্তাবের ফলে ভারতবর্ষের বিভক্তি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল বর্ণনা কর।

উত্তরা। ভূমিকা: ব্রিটিশ ভারতে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব ছিল মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি গঠনের দাবি। এ দাবি উত্থাপিত হলে উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে নতুন চেতনা ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। মুসলমানরা পৃথক জাতি। তাদের

পৃথক আবাসভূমি থাকা উচিত যা ভারত বিভক্তি অনিবার্য করে তোলে। লাহোর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করেই ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি হয়। কাজেই উপমহাদেশ বিভক্তি এবং স্বাধীন পাকিস্তান সৃষ্টিতে লাহোর প্রস্তাবের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম লীগের আন্দোলনের দিকনির্দেশনা ও পাকিস্তান সৃষ্টিতে লাহোর প্রস্তাব দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছিল। মুসলমানরা নিজেদেরকে পৃথক সত্তা হিসেবে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে প্রয়াস চালান।
লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ফলে ভারত বিভক্তি অনিবার্য: ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রথম থেকেই কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ এক সঙ্গে আন্দোলন ও সংগ্রাম করে আসছিল। কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি’জাতি তত্ত্বের ফলে মুসলমানরা তাদেরকে পৃথক জাতি হিসেবে গণ্য করে এবং তাদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার দাবি জোরদার করতে থাকে। এর ফলে ১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। লাহোর প্রস্তাব উত্থাপিত হলে মুসলিম লীগ ও ভারতের রাজনৈতিক আদর্শ ও আন্দোলন ভিন্নরূপ ধারণ করে। ফলে উভয় সম্প্রদায় দুই মেরুতে অবস্থান করে এবং প্রত্যেক সাম্প্রদায় নিজ নিজ স্বার্থ সংরক্ষণে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। শুরু হয় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। এর ফলে ভারত বিভক্তি অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

১. শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান কংগ্রেস ভারতবর্ষের জন্য যে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা করেছিল লাহোর প্রস্তাবের ফলে মুসলমানরা যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রস্তাব পরিত্যাগ করে। তারা লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সকল সাংবিধানিক পরিকল্পনা নতুনভাবে বিবেচনা করতে বলেন। কিন্তু কংগ্রেসের মতে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা ছাড়া শাসনকার্য সুচারুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। এর ফলে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভারত বিভাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে।

২. স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন লাহোর প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ যে সকল স্থানে মুসলমানগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে তাদের জন্য একাধিক স্বাধীন রাষ্টসমূহ গঠনের দাবি ছিল। যা ভারত বিভক্তি ছাড়া সম্ভব ছিল না। ফলে ভারত বিভক্তি অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।

৩. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন লাহোর প্রস্তাবে বলা হয় যে, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে যে সকল রাষ্ট্রসমূহ গঠন করা হবে তার অঙ্গরাজ্যসমূহ হবে স্বায়ত্তশাসিত। ফলে প্রদেশগুলো অধিকতর ক্ষমতা ভোগ করবে। প্রদেশগুলো স্বায়ত্তশাসিত হলে কেন্দ্রের প্রভাব হ্রাস পাবে যা ভারত বিভক্তিতে অনুপ্রাণিত করবে।

৪. মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক চেতনা লাহোর প্রস্তাব উত্থাপিত হলে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। লাহোর প্রস্তাবের ফলে মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটে। অনেক মুসলিম কংগ্রেস নেতা মুসলিম লীগে যোগদান করে। ফলে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে দাবি জোরালো হয় এবং ভারত বিভক্তি ত্বরান্বিত করে।

৫. মুসলমানদের মধ্যে নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি লাহোর প্রস্তাবের ফলে মুসলমানদের মধ্যে নতুন আশা আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়। উত্তর পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলসহ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলো নিয়ে একাধিক রাষ্ট্রসমূহ গঠনের দাবি করা হয়। যা বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে মুসলমান ও বাঙালি চেতনায় সমন্বয় ঘটেছিল। যা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান বিভক্তি ত্বরান্বিত করেছিল।
৬. মুসলিম আতীয়তাবোধ সৃষ্টি: লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হবার ফলে মুসলিম জাতীয়তাবোধ দ্রুত প্রসার পেতে থাকে। মুসলমানরা ভারতীয় জাতীয়তাবোধের পরিবর্তে ইসলামি জাতীয়তাবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে থাকে যা সমবেতভাবে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির দাবি জোরালো হয়। যা ভারত বিভক্তি দাবি জোরালো করেছিল।

৭. কংগ্রেসের মনোভাব: দীর্ঘ সময় ধরে কংগ্রেস ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। তারপর মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব নিয়ে নতুন করে আন্দোলন করার জন্য উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। ১৯৪৬ সালে তীব্র হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে বহু লোক প্রাণ হারায়। এরূপ পরিস্থিতিতে কংগ্রেস মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি ছেড়ে দেওয়ার লক্ষ্য শ্রেয় মনে করে, যা ভারত বিভক্তি অনিবার্য করে তুলেছিল।

৮. হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা: দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায় ব্রিটিশ বিরোধী তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে একত্রে। লক্ষ্ণৌচুক্তি, বেঙ্গল প্যার, অসহযোগ আন্দোলন প্রভৃতি ক্ষেত্রে তা পরস্পর সহায়ক ও পরিপূরক ছিল। কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের ফলে তাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয় যা ভারত বিভক্তির জন্য সহায়ক ছিল।

৯. ব্রিটিশ সরকারের মনোভাব লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হলে ব্রিটিশ সরকার তাদের ধ্যানধারণায় পরিবর্তন আনে। তারা বুঝতে পারে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে তা ভারত বিভক্তিরই একমাত্র সমাধান।

১০. হিন্দু নেতাদের মনোবল ধ্বংস: লাহোর প্রস্তাব উত্থাপিত হবার পর ভারতের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে হিন্দু-মুসলিম অবিশ্বাস রকমভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। দাঙ্গা, হাঙ্গামা সৃষ্টি হয়, ফলে হিন্দু নেতারা অখণ্ড ভারতের দাবি পরিত্যাগ করে লাহোর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে ভারত বিভক্তিতে সম্মত হয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ফলে ভারত বিভক্তি অনিবার্য হয়ে পড়ে। লাহোর প্রস্তাব ছিল ভারত বিভক্তির মূল কারণ। লাহোর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন প্রণীত হয়। এজন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Rounuq Jahan বলেছেন, “Lahore Resolution is a significant Chapter in the history of indo-pak sub Continent.”