অথবা, “লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ফলে কী ভারত বিভক্তি অনিবার্য হয়েছিল?
অথবা, লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির বীজ নিহিত ছিল?
উত্তর: ভূমিকা: ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে – ১৯৪০ সালে মার্চ একটি অনন্য স্মরণীয় দিন। কেননা এদিন মুসলমানদের প্রাণের দাবিসমূহ লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে উত্থাপিত হয়েছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক জগতে মুসলিমদের বেশিরভাগ সময় সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে ধরা হত। কিন্তু লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় মুসলমানদের রাজনৈতিক ভাবধারা ভিন্নপথে পরিচালিত হয়। তারা নিজেদেরকে পৃথক সত্তা হিসেবে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে প্রয়াস চালান।
লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ফলে ভারতের বিভক্তি: অনিবার্য হয়ে উঠেছিল উক্তিটির আলোচনা ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে হিন্দু ও মুসলমানদেরকে যদিও পৃথক দুটি জাতি হিসেবে ধরা হয় তবুও লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা উভয়ই ঐক্যবদ্ধ ভাবে অখণ্ড ভারতের জন্য আন্দোলন করে আসছিল। কিন্তু লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ভারতের বিভক্তি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। নিম্নে তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
১. যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান: লাহোর প্রস্তাবে মুসলমানরা যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা প্রত্যাখান করে সকল সাংবিধানিক পরিকল্পনাকে নতুনভাবে বিবেচনা করতে বলেন। কেননা মুসলমানরা মনে করেন এতে মুসলমানদের কোন প্রকারে লাভ হবে না। কিন্তু ভারতের মত এত বড় রাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ছাড়া শাসন কার্য পরিচালনা করা অসম্ভব। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা বাতিল হলে ভারত বিভক্তের পথ সুগম হয়।
২. স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন: লাহোর প্রস্তাবে বলা হয় যে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ও পূর্বাঞ্চলে যে স্থানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে তাদের জন্য একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠিত হবে। প্রয়োজনে এসকল এলাকার সীমানা পরিবর্তন করতে হবে। অর্থাৎ এই প্রস্তাবে সুস্পষ্টভাবে ভারতের বিভক্তির কথা বলা হয়। এবং পরবর্তীতে মুসলমানরা এ দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠে।
৩. প্রদেশসমূহের স্বায়শাসন: লাহোর প্রস্তাবের আরেকটি ধারায় উল্লেখ করা হয় যে, নতুনভাবে যে সকল রাষ্ট্রসমূহ গঠিত হবে তার প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যসমূহ হবে স্বায়শাসিত। অর্থাৎ এতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনে দাবি তোলা হয়। কিন্তু দেখা যায় যে আঞ্চলিকভাবে প্রদেশসমূহ স্বায়ত্ত্বশাসন পেলে কেন্দ্রের প্রভাব উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পাবে। অর্থাৎ তা ভারতের বিভক্তিতে অনুপ্রাণিত করবে।
৪. মুসলিম লীগের সম্প্রদায়িক প্রচার: প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক প্রচার চালাতে থাকে যা ভারতের বিভক্তি ডেকে নিয়ে আসে। মুসলিম লীগ দাবি করেন যে, মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র একটি জাতি। ভারতে অখণ্ড থাকলে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরাই এর কর্তৃত্ব গ্রহণ করবে। এতে মুসলমানদের কোন প্রকার লাভ হবে না। মুসলিম স্বাধী লীগের এরূপ প্রচার মুসলমাদের ধ্যান-ধারণা পাল্টে দেয়।
৫. মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রসার: লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ফলে মুসলিম জাতীয়তাবাদের ব্যাপক প্রসার হয়। এসময় মুসলমানরা ভারতীয় জাতীয়তাবোধের পরিবর্তে ইসলামী বা মুসলিম জাতীয়তাবাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়। তারা সমবেতভাবে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি থেকে শুরু করে পৃথক সরকার গঠনের দাবি জানায়। মুসলমানদের এরূপ জাতীয়তাবোধ অখণ্ড ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে।
৬. হিন্দু মুসলিম দ্বন্দ্ব: ভারতের রাজনীতিতে হিন্দু ও মুসলমানরা দীর্ঘদিন ধরে ঐক্যবদ্ধভাবে অখণ্ড ভারতের স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম করে আসছিল। লক্ষ্মৌচুক্তি, অসহযোগ আন্দোলন, বেঙ্গল প্যাক্ট সম্পাদনের সময় হিন্দু ও মুসলমানদের সম্পর্ক ছিল পরস্পরের সহায়ক ও পরিপূরক। কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের ফলে তাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের মধ্যে ভাটা পড়ে। এমনকি ভারতের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা বেধে যায়। অর্থাৎ হিন্দু মুসলমানদের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার সাথে সাথে ভারতের বিভক্তিও কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
৭. ব্রিটিশ সরকারের নমনীয়তা: ভারতে ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ব্রিটিশ সরকারও তাদের সকল কর্মকাণ্ডে ভারতের জন্য পরিচালিত করে। কিন্তু লাহোর প্রস্তাবে ভারতের বিভক্তির কথা বলা হলে ব্রিটিশ সরকার ও তার ধ্যান ধারণার পরিবর্তন করেন। ব্রিটিশ সরকার লাহোর প্রস্তাবের ফলে উপলব্ধি করেন যে, হিন্দু ও মুসলমানদেরকে অখণ্ড ভারতের আওতায় রাখা নির্বুদ্ধিতার শামিল। অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকারের এরূপ ভাবপ্রকাশ ভারতের বিভক্তিকে ত্বকরে।
৮. হিন্দু নেতাদের মনোবল ধ্বংস: লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ফলে ভারতের অনেক হিন্দু নেতাদের মনোবল ধ্বংস হয়ে যায়। যারা এতদিন অখণ্ড ভারতের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন তারাও উপলব্ধি করতে থাকেন যে, ভারতের বিভক্তি ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা নেই। কেননা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সব দিক থেকেই ব্যাপক মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। হিন্দু নেতাদের এরূপ মনোভাব ভারতের বিভক্তিতে ইন্ধন জোগায়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, লাহোর প্রস্তাব হিন্দু-মুসলমানদের সম্পর্ককে চিরতরে বিনষ্ট করে দেয়। হিন্দু ও মুসলমানদের মনে এই প্রস্তাবের ফলে একথা বদ্ধমূল হয় যে, যেহেতু রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ধর্মীয় দিক থেকে হিন্দু ও মুসলমানরা সম্পূর্ণ ভিন্ন, অতএব তাদের আবাসভূমিও হবে পৃথক। এরই ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয়। অর্থাৎ লাহোর প্রস্তাবই ভারতের বিভক্তি ঘটায়।