অথবা, ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দৃঢ়করণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের ভূমিকা আলোচনা কর।
অথবা, ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন? আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: বর্তমান যুগে জাতীয়তাবাদের ধারণা ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করেছে। এ ধারণার ভিত্তিতেই আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে। বস্তুত যখন কোনো জাতি গোষ্ঠী অন্যান্য গোষ্ঠী থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র বলে অনুভব করে স্বশাসিত হতে চায় বা নিজস্ব রাষ্ট্র কামনা করে, তখন তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়। প্রত্যেক জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র থাকার অধিকার জাতীয়তাবাদের মূলকথা। বস্তুত ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হতে বিভিন্ন জাতিকে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সুমহান চেতনাই অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়েও জাতীয়তাবাদী আদর্শই ছিল মূল চালিকাশক্তি। এটি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ যা পাকিস্তান ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে বাঙালিদের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা দান। আর এ জাতীয়তাবাদকে সুসংহত করার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন মধ্যমণি।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: নিচে যাটের দশকে শেখ মুজিবের অবদান আলোচনা করা হলো:
১. ভাষা আন্দোলন: বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের প্রথম সোপান হলো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনকে সফল করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা লাভের ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার সব সময় চেয়েছিল উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সংস্কৃতিকে চিরতরে ধ্বংস করে দিতে। কিন্তু বাঙালিরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেছে। আর এ প্রতিবাদ সুসংহত করতে শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৫২ সালে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনে আওয়ামী লীগ যে বিশেষ ভূমিকা পালন করে তাতে শেখ মুজিবুরের অবদান বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর সে বিখ্যাত বাণী “আমি ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষ্য, বাংলা আমার দেশ।
২. স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন: স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন বাঙালিদেরকে জাতীয়তাবাদ বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। পাকিস্তানের পরবর্তী ইতিহাস পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে চিন্তা করতে বাধ্য করে যে তাদের অস্তিত্বের জন্য এ অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন দরকার। বাঙালিরা যখন স্বায়ত্তশাসন দাবি করে তখন তারা শুধু উপেক্ষিতই হয়নি তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী বলেও আখ্যায়িত হয়েছে। ঠিক সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদের স্বার্থে এগিয়ে আসেন এবং সমস্ত বাঙালিকে নিয়ে স্বায়ত্তশাসন লাভে আন্দোলন শুরু করেন।
৩. ৬ দফা কর্মসূচি: ১৯৬৬ সালে ৬ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন ও পেশ করার পূর্বে শেখ মুজিবকে দফায় দফায় আন্দোলন করতে হয়েছে। ১৯৬১, ‘৬২, ‘৬৪ এবং ‘৬৫ সালে বার বার কারাবরণ করতে হয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন এক অর্থে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ গঠন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশসহ জাতীয় নেতাদেরকে আইয়ুব খানের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আহ্বান জানান। এ প্রক্রিয়ায় ১৯৬২ সালে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট গঠনের পর ১৯৬৪ সালে পুনর্জন্ম ঘটে। এসবকিছুই ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি প্রণয়ন ও তা পেশ করতে সহায়ক হয়। পূর্ব বাংলার গণমানুষের অধিকার সংবলিত যে দাবিনামা জেনারেল আইয়ুব খানের নিকট পেশ করা হয় তাই ছিল ৬ দফা দাবি।
৪. গণঅভ্যুত্থান: ৬ দফা ভিত্তিক আন্দোলন ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনে রূপ নেয়। সর্বস্তরের জনগণ আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে উঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্যারিসমাসুলভনেতৃত্বের ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ হয়। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। অপরদিকে, জাতীয় পরিষদ নির্বাচনেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু পাকিস্তানি ক্ষমতালোভীদের চক্রান্তে শেষ পর্যন্ত বাঙালিরা ক্ষমতায় যেতে পারেনি। পরিশেষে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা পায়। পরে ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
৫. ১৯৭০ সালের নির্বাচন: ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রচারণায় পূর্ব বাংলার সমস্ত জনগণ বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে বিপুলভাবে জয়লাভকরতে সহায়তা করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূর্ণ বিকাশের পূর্ববর্তী ধাপ ছিল এ নির্বাচন।
৬. ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে পূর্ব বাংলার জনগণ বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের ৭ মার্চের সে ঐতিহাসিক ভাষণ বাংলার মানুষকে পূর্ণ জাতীয়তাবাদ বিকাশে অনুপ্রাণিত করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো-দেব, তবু বাংলাকে শত্রুমুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ।” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দেশের প্রতি এ ভালোবাসা, অকৃত্রিম দেশপ্রেম, দেশকে মুক্তির জন্য এ আকুল আহ্বান, দেশের মানুষের মুক্তির জন্য এ নিঃস্বার্থ ত্যাগ সমস্ত বাঙালিদের দাঁড় করেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহান কাতারে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, বাঙালি জাতি নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। বংশ, ভাষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা প্রভৃতি বাঙালিদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছে জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্রে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন এবং ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধভাবে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এর সোনালি ফসল আসে ১৯৭১ সালের দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে। এসব ঘটনাবলি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বহিঃপ্রকাশ এবং এর অগ্রজ ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর ক্যারিসমাসুলভ নেতৃত্বের ফলে জাতীয়তাভিত্তিক বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখণ্ডের অভ্যুদয় ঘটে বিশ্ব মানচিত্রে।