সংস্কার আন্দোলন হিসেবে আলীগড় আন্দোলনের পটভূমি, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং কার্যক্রমসমূহ বর্ণনা কর।

অথবা, আলীগড় আন্দোলন কি? আলীগড় আন্দোলনের দিকগুলো আলোচনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে অবিভক্ত ভারতে যেসব সংস্কার আন্দোলন মুসলমানদেরকে অজ্ঞতা, কুসংস্কার, অশিক্ষা, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগঠিত করে তোলে তার মধ্যে স্যার সৈয়দ আহম্মদ পরিচালিত আলীগড় আন্দোলন ছিল অন্যতম। সমাজসেবা ও সমাজ সংস্কারে মহান ব্রততে স্যার সৈয়দ আহাম্মদ খানের গতিময় নেতৃত্বে আলীগড় আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে এবং চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। ব্রিটিশ শাসকগণ ক্ষমতা দখলের পর ভারতীয় মুসলমানদের অবস্থা সর্বিসহ হয়ে উঠে। মুসলমানগণ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন ও ব্রিটিশদের অসহযোগিতার কারণে ব্রিটিশদের নিকট শত্রু বলে বিবেচিত হয় এবং তাদের ধর্ম, শিক্ষা, সম্পদ সবকিছুই চাংসপ্রাপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়। স্যার সৈয়দ আহম্মদ ঐ সকল সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত মুসলমানদেরকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য শুরু করেন আন্দোলন যা আলীগড় আন্দোলন নামে পরিচিত।

আলীগড় আন্দোলনের পটভূমি: আলীগড় আন্দোলনের পটভূমি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে,

(ক) ইংরেজরা মুসলমানদের নিকট হতে এদেশের শাসন ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলো। সেজন্য ইংরেজরা মুসলমানদেরকে শাসন ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও দাবিদার মনে করতো। ফলে মুসলমানরা ব্রিটিশদের রোষানলে পতিত হয়।

(খ) মুসলমানরা বিটিশদের কাছে স্বাধীনতা হারানোর পরিপ্রেক্ষিতে তাদেরকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। ফলে মুসলমানরা ইংরেজদের সঙ্গে অসহযোগিতা এবং ইংরেজদের এড়িয়ে চলে।

(গ) মুসলমানগণ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল। সিপাহী বিপ্লব এবং বিপ্লবোত্তরকালে ইংরেজদের নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছিল মুসলমান সম্প্রদায়। মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের আক্রোশ ও বিদ্বেষপ্রসূত আচার-আচারণ সৈয়দ আহমদের চিন্তা- চেতনাকে বিপুলভাবে আন্দোলিত করে।

(ঘ) ইংরেজ ও মুসলমানদের মধ্যে বিরাজমান অসহযোগিতামূলক সম্পর্কের সুযোগ, হিন্দু সমাজ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পদে পদে উন্নতি লাভ করতে থাকে।

(ঙ) ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের প্রভাবে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে, মুসলমানগণ চরম বিপর্যয়ের মধ্যে দিনাতিপাত করতে থাকে। স্যার সৈয়দ আহমদ বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করে বোঝাতে চেয়েছিলেন, ইংরেজ মুসলিম সুসম্পর্ক * স্থাপনই অধপতিত মুসলমানদের উন্নতির পূর্বশর্ত। তাই তিনি – প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথ পরিহার করে ইংরেজদের সঙ্গে * সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।

আলীগড় আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: মুসলমানদের এ. পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে এ আন্দোলন শুরু -ও হলোও তা পরবর্তীতে বহুমুখী উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত দ হয়। উদ্দেশ্যগুলো নিম্নরূপ:

কুসংস্কার দূরীকরণ:

১. মুসলমান সমাজে বিদ্যমান গোঁড়ামি, অজ্ঞতা, কুসংস্কার ধে প্রভৃতি দূরীকরণ এবং সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে মুসলমানদের তা হৃত গৌরব ও ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার।

২. পিছিয়ে পড়া মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধকরণ ও ইংরেজ-মুসলমান সম্পর্ক উন্নয়ন আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হয়ে দক্ষ ও শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্য ভাবধারায় শিক্ষিত করে তোলা।

৩. হিন্দু জাতীয় কংগ্রেসের পাশাপাশি মুসলিম স্বার্থ রক্ষায় কর্মসূচি গ্রহণ করা।

৪. ব্রিটিশ সরকারের আস্থা অর্জন।

৫. ব্রিটিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন উচ্চ পদে মুসলমানদেরকে নিয়োগ দান।

আলীগড় আন্দোলনের কার্যক্রমসমূহ: আলীগড় আন্দোলনকে সফল করার জন্য স্যার সৈয়দ আহম্মদ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। আলীগড় আন্দোলনের ক্ষেত্রে গৃহীত কার্যক্রমগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. বই প্রকাশনা: আন্দোলনের প্রারম্ভে স্যার সৈয়দ আহম্মদ কতিপয় প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। ১৮৫৯ সালে তিনি শিল্প বিপ্লবের কারণ ও ঘটনাবলি যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে “আলবান ই-ভাগাওয়াত হিন্দ” (উর্দু) শীর্ষক গ্রন্থ রচনা করেন। এটি ১৮৭৩ সালে ২য় সংস্করণ ইংরেজিতে প্রকাশপূর্বক এক কপি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রত্যেক সদস্যের নিকট প্রেরণ করেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক William Hunter মুসলমান জনগণের দুঃখ-দুর্দশা ও ব্রিটিশ সরকারের নিপীড়নের কথা তাঁর “Indian Mussalmans” গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। সরকার, জনগণ, শাসক ও শাসিতদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটানোর জন্য স্যার সৈয়দ আহম্মদ “The Loyal Mohammedans of India” নামক গ্রন্থে মুসলমানদের দোষ-ত্রুটির কথা উল্লেখ করে প্রকাশ করেন যা সকলের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া আবুল ফজলের আইন-ই-আকবর সম্পাদনা করেন। ১৮৫৮ সালে “সিপাহী বিদ্রোহের” কারণ বইটি প্রকাশ করেন। এছাড়া শাসক ও শাসিত উভয়কে শিক্ষা দেয়ার জন্য এবং সম্ভাব্য সংঘাত ও ভুল বুঝাবুঝির কারণ দূর করতে সচেষ্ট হন। যার ফলশ্রুতি হিসেবে ভারতে বিদ্রোহের কারণ শীর্ষক পুস্তি কাও প্রকাশ করেন।

২. অনুবাদ সমিতি প্রতিষ্ঠা: মুসলমানদেরকে পাশ্চাত্য শিক্ষার সাথে পরিচিত করানোর জন্য স্যার সৈয়দ আহম্মদ খান ১৮৫৩ সালে প্রথমে একটি বিজ্ঞান সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে এটি আলীগড়ে স্থানান্তরিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান, আলোচনা, প্রচার নিজেদের ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থগুলো ইংরেজিতে এবং ইংরেজদের মধ্যে মেলামেশা ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান এবং ভাব বিনিময় করা। দেশিয় ভাষায় ভূগোল আধুনিক কলা ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত কোনো উপযুক্ত বই ছিল না। তাই এ অনুবাদ কেন্দ্রের মাধ্যমে পাশ্চাত্য বিষয়ক গ্রন্থাবলি অনুবাদের ব্যবস্থা করা হয়। এ অনুবাদ সমিতি পরবর্তীতে “সাহিত্য ও বিজ্ঞান সমিতি” নামে পরিচিতি লাভ করে।

৩. পত্রিকা প্রকাশ: পত্রিকা প্রকাশ করে জনসাধারণাকে সচেতন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ১৮৬৬ সালে বিজ্ঞান সমিতির পক্ষ থেকে “আলীগড় ইনস্টিটিউট গেজেট” নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হয়। ১৮৭০ সালে স্যার সৈয়দ আহম্মদ খান মুসলিম সমাজের রীতি-নীতি সংস্কারের জন্য “তাহজিবুল আখলাক” নামে উর্দু ভাষায় একটি পত্রিকা বের করেন। এর মূল উদ্দেশ্য হলো ভারতবাসী ও ইংরেজগণ যাতে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবগত হয়ে উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়। এছাড়াও সামাজিক অবনতির কারণ ও সমাধান ব্যাখ্যা করেন ১৮৬৪ সালে “The Mohammedan Social Reformer নামক পত্রিকায় প্রবন্ধ রচনা করেন এবং তাতে জনগণের মধ্যে শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবনের উপাদান সমৃদ্ধ করা হয়। সৈয়দ আহম্মদ লক্ষ্য করেন যে, তার স্বধর্মীয় মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষা যুগের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। আর এজন্য তিনি বলেন যে, শিক্ষা দাও, শিক্ষা দাও, শিক্ষা দাও তাহলে এ ব্যবস্থায় একদিন ভারতে সমস্ত রাজনৈতিক সামাজিক ব্যাধি দূর করতে পারে। মূল ভালো কর তাহলে বৃক্ষ সুশোভিত হবে।

৪. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন: শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য স্যার সৈয়দ আহম্মদ ১৮৭৫ সালে আলীগড়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭৭ সালে এটি “মোহামেডান এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজে উন্নীত হয় এবং পরে ১৯২০ সালে এটি ‘মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ নাম ধারণ করে। এছাড়া তিনি গাজীপুরে একটি ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীতে কলেজে রূপান্তরিত হয়। জনগণের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৮৬৪ সালে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাসমূহের জন্য একটি শিক্ষা কমিটি স্থাপন করেন।

৫. মোহামেডান এ্যাডুকেশন কংগ্রেস: মুসলমানদের শিক্ষা, সংস্কার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে ১৮৮৬ সালে মোহামেডান এডুকেশন কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নাম পরিবর্তন করে ১৮৯০ সালে “Mohammedan Educational Conference” রাখা হয়। এর মাধ্যমে আলীগড়ের বার্তা জনগণের নিকট পৌঁছে দেয়া হয়। এতে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন প্রভৃতি প্রচারিত হয় এবং মুসলমানদের মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে যুগোপযোগী পরিবর্তন সাধিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই আলীগড় আন্দোলন সুসংগঠিত হয় এবং সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।

৬. ব্রিটিশ ভারত সমিতি : ব্রিটিশ শাসকদের নিকট থেকে সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে এবং বৃটিশ ও মুসলমানদের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য ১৮৬৬ সালে “ব্রিটিশ ভারত সমিতি” গঠন করা হয়। এ সমিতির মাধ্যমে বঞ্চিত মুসলমানগণ তাদের দাবি-দাওয়া ব্রিটিশদের নিকট পেশ করেন। তবে এ সমিতি মাত্র এক বছর স্থায়ী হয়। তদুপরি কেউ কেউ এই এসোসিয়েশনকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পথিকৃৎ বলে মনে করেন।

৭. মূল্যায়ন: স্যার সৈয়দ আহম্মদ খান সদাসর্বদা নিজের কল্যাণের চেয়ে সমাজের মঙ্গল কামনা করতে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে। তিনি এমন একটি শিক্ষিত সম্প্রদায় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যারা জ্ঞান ও বুদ্ধিতে অপর সমাজের বিদগ্ধজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। যাদের উপর নির্ভর করবে জাতির ভবিষ্যৎ এবং হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের গুরু দায়িত্ব।

মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থা পর্যালোচনা করে সঠিক দিক আবিষ্কার করা হলো আলীগড় আন্দোলনের প্রধান কাজ। আলীগড় আন্দোলনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড মুসলিম মানসে এক নতুন ধ্যান-ধারণা ও কর্ম অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত করে এক নবযুগের সূচনা করে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, স্যার সৈয়দ আহম্মদ খানের জীবনব্যাপী সাধনার ফল এ আলীগড় আন্দোলন। মুসলমান সমাজকে অন্ধ অশিক্ষার গহ্বর থেকে মুক্ত করে জ্ঞানের উজ্জ্বল আলোকে আনয়ন করাই ছিল তার জীবনের ব্রত। আলীগড় আন্দোলনের সফলতার ক্ষেত্রে স্যার সৈয়দ আহম্মদ সচেতনতা সৃষ্টি করে এবং অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা পালন খানের পুত্র সৈয়দ মাহমুদও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। আলীগড় আন্দোলন কালক্রমে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে
করতে সক্ষম হয়। এর ফলে এমন এক শ্রেণির উদ্ভব হয় যারা পাশ্চাত্য এবং নিজেদের মর্যাদা রক্ষা এবং হারিয়ে যাওয়া গৌরব পুনরুদ্ধার করার জন্য নতুনভাবে চিন্তা করতে সক্ষম হয়।