অথবা, সমাজকল্যাণ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির বিভিন্ন কর্মসূচিগুলো সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির পরিচিতি রয়েছে সব দেশে। শুরুতে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির কার্য বলি কেবল যুদ্ধে আহত সৈন্যদের জন্য সীমিত ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে তা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দুর্যোগ, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও রোগব্যাধির মোকাবিলা করার লক্ষ্যে প্রসারিত করা হয়। রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির নাম বিশ্বের সবার কাছেই পরিচিত।
রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির কার্যাবলি: যুদ্ধ, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি জাতীয় দুর্যোগময় মুহূর্তে বাংলাদেশে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। নিম্নে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির গুরুত্বপূর্ণ কার্যসমূহ আলোচনা করা হলো।
১. জরুরি খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি: রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি স্বাধীনতা সংগ্রামের পর থেকে দুর্যোগ কবলিত এবং দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের জন্য জরুরিভিত্তিক খাদ্যসংস্থানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য বিতরণের ব্যবস্থা করে। এজন্য দুর্যোগকালীন বিভিন্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়।
২. খাদ্যসংস্থান কর্মসূচিঃ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি দুস্থ, অসহায় মানুষের জন্য খাদ্যসংস্থানের দায়িত্ব নিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি পেয়ে থাকে, যার সাহায্যে দরিদ্র জনগণের খাদ্যসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে।
৩. জরুরি চিকিৎসা কর্মসূচি: আন্তর্জাতিক রেডক্রস সমিতির সহায়তায় এর অধীনে জরুরি চিকিৎসা কর্মসূচি হিসেবে ৭টি ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা ইউনিট এবং ৫০ শয্যাবিশিষ্ট ৬টি ফিল্ড হাসপাতাল দুর্গতদের চিকিৎসায় পরিচালিত হচ্ছে।
৪. শীতকালীন কার্যক্রমঃ দেশের উত্তরাঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহকালে সমিতি দরিদ্রদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করে। ২০০৭ সালে বিতরণকৃত দ্রব্যের মধ্যে ২৩,১০০ পিছ কম্বল ও ৯০ কার্টন ফ্যামিলি কিটস ছাড়াও সমিতির আবেদনে বিভিন্ন সংস্থা ২৫০ পিছ কম্বল ও ২০০ পিছ কাপড় বিতরণ করে (বার্ষিক প্রতিবেদন-২০০৭)
৫. সমাজভিত্তিক দুর্যোগ মোকাবেলা কর্মসূচিঃ ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, নদীভাঙ্গনসহ নানা প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিবছর এদেশের মানুষকে আঘাত করছে। এ সমস্ত দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাসকল্পে দুর্যোগ মোকাবেলায় জনগণের সক্ষমতা ফেডারেশন আর্থিক সহযোগিতায় সমাজভিত্তিক দুর্যোগ মোকাবেলা কর্মসূচি (সিবিডিপি) বাস্তবায়ন করছে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে দুর্যোগ সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি, নিরাপদ পানি ব্যবস্থাপনায় ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মাণ, জরুরি ত্রাণ তহবিল গঠন, দুর্যোগ মোকাবিলায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন ইত্যাদি কার্যক্রম করা হয়। বর্তমানে এ কর্মসূচিটি ৫টি উপকূলীয় জেলাসহ ৩৪টি দুর্যোগপ্রবণ জেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে।
৬. ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি): বাংলাদেশের উপকূলবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ ৭১০ কি.মি. দৈর্ঘ্য এলাকা জুড়ে বসবাসকারী সর্বাধিক বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করার লক্ষ্যে প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম চালু আছে। এ অঞ্চলে বসবাসকারী এক কোটির অধিক জনসাধরণের জন্য প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি শুরু করে। ১৯৭৩ হতে এ কর্মসূচিটি সরকারের সাথে যৌথভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এ কর্মসূচির আওতায় ১১টি উপকূলীয় জেলায় ৩২টি উপজেলার ২৭৪টি ইউনিয়নে ২,৮৪৫টি ইউনিটের আওতায় ২৮,৪৫০ জন পুরুষ ও ১৪,২২৫ জন মহিলাসহ মোট ৪২,৬৭৫ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক এবং ১৬০ জন কর্মকর্তা- কর্মচারী কাজ করছেন।
৭. স্বাস্থ্য কর্মসূচিঃ জনগণের স্বাস্থ্যরক্ষা, রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ের জন্য এ সোসাইটি বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে। ঢাকায় হলিফ্যামিলি হাসপাতাল ও হাসপাতাল সংলগ্ন নার্সিং স্কুলটি এ সোসাইটির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া জনগণকে পরিকল্পিত পরিবার গঠনে সচেতন করে তোলা, পুষ্টিদান ও প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দানের ক্ষেত্রে এ সোসাইটি কাজ করে যাচ্ছে।
৮. মাতৃ ও শিশু কল্যাণ কর্মসূচি: বাংলাদেশে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি ২১টি মাতৃসদন ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের মাধ্যমে বছরে গড়ে ৫০ হাজার শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে।
৯. ধাত্রীবিদ্যা ও ধাই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমঃ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজস্ব মাতৃসদনের
‘মাধ্যমে ধাত্রীবিদ্যা ও ধাই সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দান করে চলছে।
১০. এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসঃ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি হাসপাতাল রোগীদের আনা নেওয়া সুবিধার্থে বিভিন্ন হাসপাতালে ১৮টি এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এসব এ্যাম্বুলেন্স ছাড়া ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি বাকি ২৭টি এ্যাম্বুলেন্স সোসাইটির ভ্রাম্যমাণ ইউনিট হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
১১. এতিম পুনর্বাসন কার্যক্রম: রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি ঢাকায় একটি এতিমখানা পরিচালনা করছে যেখানে ১০০ এতিম শিশুদের লালন পালন ও পুনর্বাসনের সুযোগ পাচ্ছে। এ সোসাইটি ভবিষ্যতে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে আর ও ৮টি এতিমখানা পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির মাধ্যমে এতিম শিশুরা আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দুর্যোগ, যুদ্ধ, ক্ষুধা, দারিদ্রদ্র্য, অসহায় মানুষদের রোগ-ব্যাধি নিরাময়ের জন্য তাদের পাশে এসে সহযোগিতার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের সেবা কার্যক্রমমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। ফলে বিশ্বব্যাপী দুঃস্থ মানুষের সেবায় রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির গুরুত্ব অপরিসীম।