অথবা, সমাজজীবনে সাম্যের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা কর।
অথবা, সমাজজীবনে সাম্যের প্রভাব উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: সাম্য সম্পর্কিত আলোচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি বহুল আলোচিত বিষয়। প্রাচীনকালে গ্রিক দার্শনিকগণ থেকে শুরু করে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পর্যন্ত সকলেই সাম্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন। সাম্য ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে যুগে যুগে মানুষ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। সাম্য মানবজীবনে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সাম্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোন জাতিই উন্নয়নের শিখরে আরোহণ করতে পারে না।
সাম্য: সাধারণভাবে সাম্য বলতে বুঝায় সকল মানুষই সমান। তাই প্রত্যেকে সমান সুযোগ সুবিধা, সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করতে চায়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্য শব্দটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়। বাস্তবে মানুষে মানুষে শারীরিক ও মানসিক গঠন ও গুণগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পার্থক্য বর্তমান। তাই সাম্য বলতে মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত সুযোগ সুবিধার সমতাকে বুঝায়।
সমাজজীবনে সাম্যের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা: আধুনিক রাষ্ট্রতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম। স্বাধীনতা যেমন একটি রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য, তেমনি রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সফলতার জন্য সাম্য অপরিহার্য। সমাজের যাবতীয় বৈষম্য ও শ্রেণিবিভেদমূলক অশান্তি দূর করে সমাজে একটি সহনশীল, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সমাজজীবনে সাম্যের গুরুত্ব সর্বাধিক। সমাজে সাম্যের প্রতিষ্ঠা ছাড়া প্রত্যেকে যে যার যোগ্যতা অনুসারে ব্যক্তিত্ব বিকাশের সমান সুযোগ পায় না। নিম্নে সমাজজীবনে সাম্যের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. সামাজিক ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য: সমাজে অসাম্য ও শ্রেণিবিভেদ থাকলে ঐ সমাজে শাস্তি ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব হয় না। তাই সমাজে শান্তি, সৌহার্দ্য ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মানবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য সাম্যের ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের দরিদ্র শ্রেণির ধনীদের প্রতি শ্রেণিবিপ্লব এড়াতে এবং ধনীদের শোষণ, নিপীড়ন ও পুলিশি নির্যাতন এড়ানোর জন্য এবং মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য তাই সমাজে সাম্য প্রয়োজন।
২. সমাজে সততা ও নৈতিকতাবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য: সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও নৈতিকতার উন্নত ভিত্তির উপর মানুষের জীবনধারা প্রবর্তনের জন্য ধনী ও দরিদ্রের মাঝে বৈষম্য কমিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। সাধারণত সমাজে ব্যাপক শ্রেণিবৈষম্য থাকলে এক শ্রেণির অতি দরিদ্র মানুষ জীবিকার তাগিদে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুনখারাবি প্রভৃতি সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটায় এবং প্রকারান্তরে ধনী শ্রেণি দরিদ্র শ্রেণিকে তাদের অধিকার ও প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে তৎপর হয়। আর সমাজের এসব অনিয়ম ও ক্ষতিকর দিক লাঘব করে সমাজে সততা, বিশ্বাস ও নৈতিকতাবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
৩. সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে: সমাজে সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজের মানুষে মানুষে কুলিন ও অকুলিন, ধনী ও দরিদ্র এবং শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের ক্ষেত্রে ভেদাভেদ ঘুচাতে হবে। আর এ সবই সম্ভব হবে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সুতরাং সমাজে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সাম্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৪. আয় ও সম্পদের সুষ্ঠু কটনের ক্ষেত্রে: একটি সাম্যহীন সমাজ উচ্চ ও নিম্ন-দু’টি শ্রেণিতে বিভক্ত থাকে। ফলে সমাজে ধনবৈষম্য বিরাজ করে। এক্ষেত্রে উচ্চবিত্তরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করে। পক্ষান্তরে, নিম্নবিত্তরা দুঃখকষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করে। কিন্তু আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে সমতা বিরাজ করলে সমাজের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য রোধ করা সম্ভব। অতএব আয় ও সম্পদের সমবন্টনের ক্ষেত্রে সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
৫. ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে: কোন সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা না হলে ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। কারণ সমাজে যদি অসাম্য বিরাজ করে, তাহলে অপেক্ষাকৃত সবল ব্যক্তিরা দুর্বল ব্যক্তিদের উপর হস্তক্ষেপ করবে। এক্ষেত্রে দুর্বল ব্যক্তিরা সমাজে তুচ্ছ হয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি ও প্রতিবাদী মনোভাব গড়ে উঠে। ফলে সমাজে অশান্তি ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হীনতার উদ্ভব ঘটে। কিন্তু সমাজে সমতা বিরাজ করলে ব্যক্তিস্বাধীনতায় কেউ সহজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সুতরাং সমাজে ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার জন্য সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
৬. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে: সমাজে সাম্য ছাড়া অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন। অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা না হলে সমাজে সুষ্ঠু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ইতিবাচক হয় না। ফলে সমাজে আয়ের বৈষম্য ও ধনবৈষম্য সৃষ্টি হয়। এর ফলে মানুষের কর্মের অধিকার ও জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে পারে না। অতএব দেখা যাচ্ছে, সমাজে ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সাম্যের প্রয়োজন অত্যন্ত জরুরি।
৭. ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে : সমাজে মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও নৈতিক মান উন্নত হলেই ব্যক্তিত্বের সুষ্ঠু বিকাশ সম্ভব হয়। কিন্তু সমাজে সুষ্ঠু সমতা প্রতিষ্ঠা না হলে নৈতিক গুণাবলির উন্নতি সম্ভব হয় না। ফলে মানুষের সুষ্ঠু ব্যক্তিত্বের বিকাশও সম্ভব হয় না। সুতরাং সমাজে ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্য সমতা বা সাম্যের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
৮. সমাজে সার্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায়: সমাজের সার্বিক শাস্তি নির্ভর করে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, বৈষম্য হ্রাস, নৈতিক মান, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয় এবং সর্বোপরি সমাজে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, সহমর্মিতা, আস্থা, শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ ইত্যাদি বিষয়ের উপর। কিন্তু সমাজে অসাম্য বিরাজ করলে উপরিউক্ত বিষয়গুলো সমাজে থাকে না। ফলে সমাজের সার্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না। সুতরাং সমাজে সার্বিক শাস্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাম্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সমাজে সাম্যের অবস্থা আইনের চোখে সকলের সমতা ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার সুষম বণ্টন, সকলের আত্মোপলব্ধি ও আত্মবিকাশের সুযোগ, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাঝে। সাম্যের উপস্থিতি স্বাধীনতাকে প্রাণবন্ত করে এবং গণতন্ত্রের ভিত্তিকে মজবুত করে। Karl Marx তাঁর কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে প্রথমেই উল্লেখ করেছেন, “পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত সমাজ এসেছে, তার সকল সমাজই শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে এসেছে।” এ হিসেবে সাম্যবাদী সমাজ থেকে দাস যুগে, দাস যুগ থেকে সামন্ত এবং সামন্ত যুগ থেকে পুঁজিবাদী যুগ, যা বর্তমানে চলছে। কিন্তু আদিম সাম্যবাদ ছাড়া কোন সমাজেই সমতা ছিল না। সুতরাং বলা যায়, সমাজের ভারসাম্য ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রক্ষায় সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম।