অথবা, সামাজিক নীতির সংজ্ঞা দাও। সামাজিক নীতি প্রণয়নে সমাজকর্মীর কি ভূমিকা রয়েছে সেগুলো লিখ।
উত্তর: ভূমিকাঃ আধুনিক সমাজকর্ম বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান ও দক্ষতা ভিত্তিক একটি পেশাদার সেবাকর্ম যা ব্যক্তিগত,
দক্ষগত ও সমষ্টিগত প্রয়োজন পূরণ ও সমস্যা মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা পালন ক্ষমতার বিকাশে সক্ষম করে। সামজকর্ম হলো মানবীয় সম্পর্ক বিষয়ক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও দক্ষতাভিত্তিক একটি পেশাদার সেবাকর্ম যা ব্যক্তিতে এককভাবে কিংবা দক্ষগতভাবে ব্যক্তিগত ও সামজিক সন্তুষ্টি এবং স্বাধীনতা লাভে সাহায্য করে।
সামাজিক নীতি: সামাজিক নীতি হচ্ছে সেসব সুশৃঙ্খল নিয়ম-কানুন বা নির্দেশ যা সমাজ কল্যাণমূলক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করা হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা: সামাজিক নীতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা প্রদান করা হলো-
Encyclopedia of Social Work in India-এর ভাষায়, “সামাজিক নীতি প্রণয়ন করা হয় সামাজিক উদ্দেশ্য নির্দিষ্টকরণ এবং সেই উদ্দেশ্য অর্জনের পর্যাপ্ত সম্পদ সংগ্রহ ও তার বিনিয়োগের প্রকৃতি বা ধরন নির্ধারণের জন্য।”
অধ্যাপক টিটমাস এর মতে, “জনগণের কল্যাণার্থে সরকার কর্তৃক স্বতঃস্ফূর্তভাবে গৃহীত নীতিকে সামাজিক নীতি বলে।” অধ্যাপক স্নেক এর মতে, “যেসব নীতি জনকল্যাণের পথ নির্দেশ করে তাকেই সামাজিক নীতি বলা হয়।”
The Social Work Dictionary-তে বলা হয়েছে, “সামাজিক নীতি হলো কোনো সমাজের ব্যক্তি দল ও সমটি এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণে পথনির্দেশ দানকারী কার্যক্রম ও বিধি বিধান, যা সামাজিক প্রথা ও মূল্যবোধেরই ফলশ্রুতি।
সুতারং বলা যায়, যেসব সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন বা নির্দেশ যা সরকার বা সমাজকর্তৃক সমাজ কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ, পরিচালনা এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্য আদর্শ হিসেবে কাজ করে তাকে সামাজিক নীতি বলে।
সামাজিক নীতি প্রণয়নের বিভিন্ন ধাপ/পর্যায়ে একজন সমাজকর্মীর ভূমিকা তুলে ধরা হলোঃ
১. সামাজিক নীতির জন্য অনুভূত চাহিদা চিহ্নিতকরণে সমাজকর্মী: সামাজিক নীতির যাত্রা শুরু হয় সামাজিক কোনো সমস্যা সমাধানে বা কোনো অনুভূত চাহিদাকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ কোনো ক্ষেত্রে নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন তা নির্ধারণের মাধ্যমে সামাজিক নীতি প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। এক্ষেত্রে জনগণের অনুভূত চাহিদার ভিত্তিতে সামাজিক নীতি প্রণয়নের কাজ শুরু হয়।
একজন সমাজকর্মী সামাজিক পরিমণ্ডলে কাজ করতে গিয়ে জনগণের অনুভূত প্রয়োজন চাহিদা চিহ্নিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। বিভিন্ন ব্যক্তির প্রয়োজন ও চাহিদা বিভিন্ন রকমের তাই বলে প্রত্যেকের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে সামাজিক নীতির ক্ষেত্র স্থির করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সমাজকর্মী অধিকাংশ জনগণের প্রয়োজনকে বিবেচনায় এনে সামাজিক নীতি ক্ষেত্র নির্ধারণ করে।
২. নীতি প্রণয়নে প্রাসঙ্গিক তথ্য সরবরাহঃ সামাজিক নীতি প্রণীত হয়ে থাকে বাস্তবভিত্তিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে। বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ব্যতিরেকে বাস্তবমুখী ও কার্যকর সামাজিক নীতি প্রণয়ন সম্ভব নয়। সমাজকর্মীরা সমাজকর্ম অনুশীলন করতে গিয়ে সামাজিক গবেষণা কৌশল প্রয়োগ করে নীতি প্রণয়নে প্রয়োজনীয় প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। সংগৃহীত এসব তথ্য নীতি প্রণেতাদেরকে বাস্তবমুখী নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
৩. নীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে: সামাজিক নীতি প্রণয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো কমিটি গঠন। এ কমিটি নীতি প্রয়ণনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে থাকে। বাস্তব প্রয়োজন ও সমস্যা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন সমাজকর্মী নীতি প্রণয়ণ কমিটির সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে সামাজকর্মী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, জন অংশগ্রহণ নিশ্চতকরণ, তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের মতামত গ্রহণ জনগণকে সংগঠিত করন প্রশাসনিক সাহায্য সহযোগিতা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে গুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন।
৪. খসড়া প্রস্তাব তৈরিতে: নীতি প্রণয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো খসড়া প্রস্তাব/নীতি প্রস্তুত করা। কোনো ক্ষেত্রে অনুভূত প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে সামাজিক নীতি প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গৃহীত সিদ্ধন্তের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে তথ্যের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে খসড়া প্রস্তাব তৈরি করা হয়।
প্রতিটি পর্যায়ে সমাজকর্মী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। খসড়া প্রস্তাব তৈরি কালে সমাজকর্মী জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করাসহ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নিশ্চিত করেন। সমাজকর্মী বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখেন যাতে কোনো ‘Vague policy’ বা অস্পষ্ট নীতি প্রণীত না হয়। এছাড়া সমাজকর্মী বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখেন নীতি যাতে বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে গৃহীত তথ্যের আলোকে যৌক্তিকভাবে প্রণীত হয়।
৫. নীতি বিশ্লেষণ ও অনুধ্যানঃ খসড়া নীতি প্রণয়নের পরবর্তী ধাপ হলো প্রস্তুতকৃত খসড়া নীতি বিশ্লেষণ ও অনুধ্যান। এ পর্যায়ে প্রণীত নীতির বিভিন্ন দিক অনুধ্যান করা এবং নীতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর যথার্থতা যাচাই করা হয়। নীতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর যথার্থতা যাচাই করা হয়। নীতি বিশ্লেষণ এক প্রকার মূল্যায়ন। অর্থাৎ নীতি বিশ্লেষণ হল সুশৃঙ্খল উপায়ে কোনো নির্দিষ্ট নীতি এবং যে প্রক্রিয়ায় নীতিটি গঠিত হয়েছে তার মূল্যায়ন করা। নীতি বিশ্লেষণ ও অনুধ্যানের মাধ্যমে প্রথমত: নীতির গঠনগত ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলে তা সংশোধন করা সম্ভব হয়। দ্বিতীয়ত নীতির বাস্তব প্রয়োগ উপযোগিতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। সমাজকর্মীরা নীতি বিশ্লেষণ ও অনুধ্যানের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষজ্ঞের ভূমিকা পালন করতে পারেন। পাশাপাশি সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে নীতির বাস্তব প্রয়োগ উপযোগিতা পরীক্ষা করে নীতিকে যৌক্তিক কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। এছাড়া নীতির পক্ষে জনমত যাচাই করার ক্ষেত্রেও সমাজকর্মী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
৬. খসড়া নীতির পরীক্ষামূলক অনুশীলন: নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হলো প্রস্তাবিত খসড়া নীতির অনুশীলন। এ পর্যায়ে খসড়া নীতির পরীক্ষামূলক অনুশীলনের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে গৃহীত খসড়া নীতির বাস্তব প্রয়োগ উপযোগিতা যাচাই করা হয়। পরীক্ষামূলক অনুশীলনের মাধ্যমে নীতির ত্রুটি বিচ্যুতি চিহ্নিত করে বাস্তব উপযোগী করা হয়। এ পর্যায়ে একজন সমাজকর্মী নীতি অনুশীলনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে নীতির দুর্বলতা চিহ্নিত করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পরিবর্তন ও সংশোধনের সাহায্য করতে পারেন। আবার গবেষণা কৌশল ব্যবহার করে নীতির যৌক্তিকতা যাচাই করে চূড়ান্ত নীতি প্রণয়নের দিক নির্দেশনা দিতে পারেন।
৭. চূড়ান্ত নীতি প্রণয়নঃ নীতি প্রণয়নের সর্বশেষ পর্যায় হলো চূড়ান্ত নীতি প্রণয়ন এ পর্যায়ে নীতি চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয় এবং বিধিবদ্ধকরণের মাধ্যমে নীতি উপস্থাপন করা হয়। খসড়া নীতি প্রণয়ন খসড়া নীতি বিশ্লেষণ ও অনুধ্যান শেষে পরীক্ষামূলক অনুশীলন করা হয়। এ পর্যায়গুলো নীতির প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সংশোধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে নীতিকে একটি চূড়ান্ত আকার দেয়া হয়। অতঃপর নীতিকে অনুমোদনের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করা হয়। খসড়া নীতি প্রণয়ন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত নীতি প্রণয়নের প্রতিটি পর্যায়েই সমাজকর্মীরা তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, নীতির সম্ভাব্যতা ও প্রয়োগ উপযোগিতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে নীতিকে বাস্তব উপযোগী এবং কার্যকর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, একজন সমাজকর্মী একাধারে একজন সংগঠক, জনমত গঠনকারী, একজন বিশেষজ্ঞ এবং একজন গবেষক। অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতার মাধ্যমে একজন সমাজকর্মী অনুভূত প্রয়োজন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত নীতি প্রণয়ন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরের কার্যকর ভূমিকা রাখার মাধ্যমে নীতিকে বাস্তব ও সময় উপযোগী করে তুলতে পারেন।