সামাজিক পরিকল্পনা কি? পরিকল্পনার গুরুত্ব আলোচনা কর।

অথবা, সামাজিক পরিকল্পনার সংজ্ঞা দাও। পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ কর।

অথবা, সামাজিক পরিকল্পনা কাকে বলে? পরিকল্পনার তাৎপর্য সম্পর্কে যা জান লিখ।

উত্তর: ভূমিকাঃ সামাজিক পরিকল্পনা হচ্ছে প্রত্যাশিত কোনো কার্য সম্পাদনের পূর্বপ্রস্তুতি। এই প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় কোনো কার্যক্রম, প্রক্রিয়া বা কৌশল অনুসরণের মাধ্যমে। এরূপ কার্যক্রম বা প্রক্রিয়া কখন, কোথায়, কিভাবে, কার মাধ্যমে, কত সময়ে, কম অর্থ ব্যয়ে কার্য-সম্পাদনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছানো যাবে পরিকল্পনা এসব নির্দেশ করে। যে-কোনো সমাজ বা দেশের আর্থ-সামাজিক কল্যাণ ও উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি ও পূর্বশর্ত হচ্ছে বাস্তবমুখী সামাজিক পরিকল্পনা, সুষ্ঠু সামাজিক পরিকল্পনা ব্যতিরেকে লক্ষ্যে পৌছানো সম্ভব নয়। পরিকল্পনা হচ্ছে, ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের রূপরেখা বা সুশৃঙ্খল পদক্ষেপ।

সামাজিক পরিকল্পনার সংজ্ঞা: সাধারণত সামাজিক পরিকল্পনা বলতে কোনো বিষয়ে কি করতে হবে, কখন করতে হবে, কিভাবে করতে হবে, কি দিয়ে করতে হবে প্রভৃতি রূপরেখাকে বুঝায়। ব্যাপক অর্থে বলা যায়, কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছার নিমিত্তে এর আওতাধীন সম্পদের সমবন্টনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের সুশৃঙ্খল পদক্ষেপ হচ্ছে সামাজিক পরিকল্পনার একটি কাজের অগ্রিম চিন্তা ও মনস্তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিজাত প্রক্রিয়া।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা:

Robert L. Barker (1995: 284) এর সংজ্ঞানুযায়ী, “Planning is the process of specifying future objective, evaluating the means for achieving them and making deliberate choices about appropriate courses of action.” (অর্থাৎ সামাজিক পরিকল্পনা হলো ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নির্ধারণ, সেগুলো অর্জনের বিভিন্ন পন্থার মূল্যায়ন এবং উপর্যুক্ত কার্যক্রমের সুচিন্তিত বাছাই প্রক্রিয়া।

আর্থার ডানহাম (Arthur Dunham) এর মতে, “Planning is fundamentally and intellectual process, a mental pre-disposition of to do work in an orderly way to think before act in the light of facts, rather than guesses.” অর্থাৎ সামাজিক পরিকল্পনা হচ্ছে মৌলিকভাবে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়া, সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করা, কাজ করার পূর্বে চিন্তা করা, অনুমানের পরিবর্তে তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করার একটি মানসিক পূর্বাবস্থা।

Newman এর মতে, “Planning is decided in advance what is to be done, that is planning is a profected course of action.”

H. B Trecker (1955) এর মতে, “Planning is the conscious and deliberate guidance of thinking so as to create logical means of achieving agreed upon goals.” অর্থাৎ সামাজিক পরিকল্পনা হচ্ছে সচেতন ও সুচিন্তিত নির্দেশনা মতে ঐক্যবদ্ধ উদ্দেশ্য অর্জনের যৌক্তিক ভিত্তি সৃষ্টি করা যায়।

Social work Dictionary (1995) এর সংজ্ঞানুযায়ী, “Planning is the process of specifying future objectives, evaluating the means for achieving them and making deliberate choices about appropriate courses of action.”

আলবার্ট ওয়াটারসন (Albert waterson) বলেন, “Planning is an organized, conscious and continual
attempt to select the best alternatives to specific goals.” অর্থাৎ, সামাজিক পরিকল্পনা হলো বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্ভাবনা বিকল্পের সর্বোত্তম নির্বাচনের সচেতন ও ক্রমাগত প্রচেষ্টা, বিভারস (Beavers) এর মতে, “Planning is the working out in broad outlines the thing that needed to be done and the methods for doing them.”

সামাজিক পরিকল্পনার গুরুত্বঃ সামাজিক পরিকল্পনা যত যুগোপযোগী ও গঠনমূলক হবে তত তার সুফল পাওয়া মাঁবে। সামাজিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সমাজ কাঠামো, প্রতিষ্ঠান জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বক্ষেত্রেই উন্নয়ন সাধিত হয়। এছাড়াও আয় বৈষম্য দরিদ্র ও বেকারত্ব রোদন সামাজিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব। নিম্নে সামাজিক পরিকল্পনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হলো:

১. সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন: সকল কাজেরই লক্ষ্য থাকে। সামাজিক পরিকল্পনা কাজের লক্ষ্যে পৌছিয়ে দেয়। সামাজিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ করলে একটা দেশ তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছাতে সক্ষম হয়। পরিকল্পনাহীন কাজ নাবিকহীন জাহাজের মতো।

২. কাঙ্ক্ষিত সামাজিক পরিবর্তন: সুশৃঙ্খল সামাজিক পরিকল্পনা দেশে কাঙ্ক্ষিত সামাজিক পরিবর্তন আনয়ন করে। ৪ অনুন্নত দেশকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে উদ্ধার করার একমাত্র উপায় হচ্ছে যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। সামাজিক পরিকল্পনা ঠিক করে দেয় কিভাবে কোন পদ্ধতি অবলম্বন করলে কাঙ্ক্ষিত সামাজিক পরিবর্তন হবে।

৩. সমন্বয় সাধন: সামাজিক পরিকল্পনা বিভিন্ন কর্মসূচির মাঝে সমন্বয় সাধন করে থাকে। ফলে জনগণের অনুভূত প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভব। প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি বিভাগের কার্যক্রম পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

৪. সম্পদের সুষম বণ্টন: সামাজিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা যায়। একদিকে দেশের সম্পদ সীমিত অন্যদিকে যদি সম্পদের সমবন্টন নিশ্চিত করা না যায় তাহলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব নয়। তাই সামাজিক পরিকল্পনা সম্পদের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করে থাকে।

৫. পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নির্ধারণঃ কোনো পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অবলম্বন করলে দেশকে ক্ষতিকরণ অবস্থা থেকে রক্ষা করা যাবে। কোন কর্মসূচি গ্রহণ করলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব হবে তা সামাজিক পরিকল্পনার মাধ্যমে জানা যায়।

৬. জনকল্যাণ সাধন: সামাজিক পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হলো জনকল্যাণ সাধন করা। অপরিকল্পিত কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ সাধন করা সম্ভব নয়। এছাড়া পরিকল্পিত অর্থনীতি, উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা প্রভৃতির জন্যও সামাজিক পরিকল্পনার প্রয়োজন।

৭. গতিশীল সমাজব্যবস্থা: সামাজিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থাকে গতিশীল রাখা সম্ভব। সামাজিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ফলে সমাজের গতিধারা স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে। ফলে সমাজের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকে। সমাজ উন্নয়নের দিকে ধাবিত হয়।

৮. দায়িত্ব ও কর্তব্য বণ্টনঃ বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে দায়িত্ব ও কর্তব্য বণ্টন এবং তা পালনের মধ্য দিয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। তাই সুষ্ঠুভাবে কার্য সম্পাদনের নিমিত্তে দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে বণ্টন ও পালন করতে হবে। আর এজন্য সুষ্ঠু সামাজিক পরিকল্পনার প্রয়োজন।

৯. মূলধন গঠন: মূলধনের প্রবৃদ্ধি ঘটানো সামাজিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সম্ভব। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন মূলধন। মূলধন থাকলেই তা বিনিয়োগ করা যাবে। মূলধন গঠনের সঞ্চয়ের মনোবৃত্তি থাকতে হবে। এজন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যা পরিকল্পনার মাধ্যমে সহজতর হয়

১০. সমাজকল্যাণের লক্ষ্য অর্জন: সমাজকল্যাণের লক্ষ্য অর্জনে পরিকল্পনা সহায়তা করে। সমাজকল্যাণের লক্ষ্য হলো সমাজের সমস্যাগ্রস্ত মানুষকে এমনভাবে সহায়তা করা যায় যাতে তারা সক্ষমকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারে।

১১. বেকারত্ব দূরীকরণ : বেকারত্ব দূরীকরণে সামাজিক পরিকল্পনার যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। দেশের বেকার জনগোষ্ঠিকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার ব্যাপারটি সামাজিক পরিকল্পনায় গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়।

১২. জরুরি অবস্থা মোকাবেলা: প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলায় সামাজিক পরিকল্পনায় ব্যাপক কর্মসূচি থাকে। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি প্রভৃতি জরুরি অবস্থা মোকাবেলা করা যায় পরিকল্পিত অথনীতির মাধ্যমে।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দেশের সার্বিক উন্নয়নে সামাজিক পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে দেশের আপামর জনসাধারণের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য প্রয়োজন উত্তম সামাজিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সঠিকভাবে বাস্ত বায়ন। দেশের জাতি ক্ষেত্রে সামাজিক পরিকল্পনার গুরুত্ব অপরিসীম।