সার্বভৌমত্বের বহুত্ববাদী ধারণা আলোচনা কর।

অথবা, সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে বহুত্ববাদী মতবাদ ব্যাখ্যা কর।

উত্তরা ভূমিকা: বহুত্ববাদ হলো একত্ববাদের কেন্দ্রীভূত, সর্বাত্মক ও অবাধ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়ার ফল। তবে বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় কেবল একত্ববাদের সমালোচনা হিসেবে নয়, স্বতন্ত্র রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবেও বহুত্ববাদ সুপ্রতিষ্ঠিত। বহুত্ববাদের সার্থক প্রবক্তা হিসেবে Gierke, Maitland, Barker, Laski, Maclver, Cole, Duguit প্রমুখ ব্যক্তির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা একত্ববাদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। এরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করার পক্ষপাতী।

সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে বহুত্ববাদী ধারণা: সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত বহুত্ববাদের উত্তবের পিছনে দু’টি মূল কারণ কাজ করেছে। যথা:

ক. একত্ববাদী আইনানুগ সার্বভৌমিকতার বিরোধিতা করা এবং

খ. রাষ্ট্রের এলাকার মধ্যে বিভিন্ন সংঘ সংগঠনের স্বাধীন অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা।

বহুত্ববাদী ধারণা: বহুত্ববাদীদের মতানুসারে মানুষ হলো সামাজিক জীব। মানুষের সামাজিক প্রকৃতি বিকশিত হয় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে। এসব সংগঠন মানবসমাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠে। এগুলো রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট নয়। এসব সংঘ সংগঠনের শক্তির ভিত্তি হলো মানুষের স্বাভাবিক আনুগত্য। এদের শক্তি রাষ্ট্রীয় শক্তির উপর নির্ভরশীল নয়। সমাজবদ্ধ মানুষ তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও বিবিধ প্রয়োজন পূরণের তাগিদে রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করে। তেমনি অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের উপর মানুষের এ নির্ভরশীলতা আরও বেশি। Prof. Laski এর মতানুসারে, “. society is federal, authority must be federal also. ” Because

বহুত্ববাদের মূলকথা: সার্বভৌমত্বের বহুত্ববাদী মতবাদ অনুসারে রাষ্ট্রের ক্ষমতা চরম ও অসীম নয় এবং সার্বভৌমিকতাও অবিভাজ্য নয়। সমাজের অন্যান্য সংগঠনসমূহও রাষ্ট্রের মতোই স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের মত এরাও সার্বভৌম। সংগঠনগুলো সমানাধিকারসম্পন্ন এবং এদের কার্যাবলিও গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান। রাষ্ট্র এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

Prof. Laski এর মতে, “বিভিন্ন ধরনের সংগঠনের মধ্যে রাষ্ট্রও একটি সংগঠন।” (The state is only one among many forms of human association.) বস্তুত, রাষ্ট্রের চরম ও অসীম সার্বভৌমিকতার মতবাদ মানবজাতির স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, সামাজিক বিজ্ঞানের কোন তত্ত্বই সম্পূর্ণরূপে ত্রুটিমুক্ত কিংবা সমালোচনা মুক্ত নয় একথা হলফ করে বলা যায়। আধুনিক রাষ্ট্রতান্ত্রিক বিশ্বে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণা নিয়ে একত্ববাদীদের যেমন রয়েছে বিভিন্ন যুক্তি, তেমনি রয়েছে তাদের অনেক সমালোচনা; যার ফলশ্রুতিরূপে এসেছে সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী ধারণা। সে যাহোক, আমরা দু’টি তত্ত্ব ও বিশ্লেষকগণের মতামত পর্যালোচনা করে একথা বলতে পারি যে, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নে সার্বভৌম বা চূড়ান্ত ক্ষমতা কেবলমাত্র রাষ্ট্রেরই আছে এবং রাষ্ট্রেরই থাকা উচিত। এদিক থেকে বিবেচনা করলে সার্বভৌমত্বের একত্ববাদই গুরুত্বের দাবিদার। অপরদিকে, রাষ্ট্রের মত রাষ্ট্রের অন্যান্য সংঘ বা সংগঠন ও জনগণের প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে তাদেরও একটা ইতিহাস আসে। এ থেকে দেখা যায়, রাষ্ট্রই একমাত্র নিয়ন্তা নয়। এভাবে বহুত্ববাদের কথা চলে আসে।