অথবা, সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্যসমূহ লিখ।
উত্তরঃ ভূমিকা: সার্বভৌমিকতার বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বস্তুত সার্বভৌমত্বের তাত্ত্বিকরা এসব বৈশিষ্ট। অধ্যাপক আর. জি. গ্যাটেল তাঁর ‘Political Science’ গ্রন্থে সার্বভৌমিকতার বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন।
সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্যসমূহ: সার্বভৌমিকতার সংজ্ঞা ও স্বরূপ সম্পর্কিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এর কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এসব বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বভৌমিকতার ধারণাটি সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করা সম্ভব হয়। নিম্নে সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো যথাপরিসরে তুলে ধরা হলো:
১. মৌলিকতা ও চরমতা: রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা হলো আদি ও অকৃত্রিম ক্ষমতা। এ ক্ষমতা কোন সৃষ্ট ক্ষমতা নয়। সার্বভৌমিকতা অপর কোন শক্তির উপর নির্ভরশীল হতে পারে না। এ ক্ষমতা মৌলিক ও অকৃত্রিম। এ হলো রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য উপাদান। E. C. Ewing এর মতে, রাষ্ট্রের মৌলিকত্ব হলো সার্বভৌমত্ব।
২. সর্বজনীনতা: সর্বব্যাপকতা সার্বভৌম ক্ষমতার অপর এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সার্বভৌমিকতা সর্বব্যাপক বা সর্বজনীন। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব সমভাবে পরিব্যাপ্ত। রাষ্ট্রের এলাকাভুক্ত কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের এ কর্তৃত্বের বাইরে থাকতে পারে না। রাষ্ট্র যে আইন প্রণয়ন করে তা তার এলাকাভুক্ত সকল ব্যক্তি ও সংগঠনের উপর সমানভাবে প্রযোজ্য। এ সম্পর্কে Prof. Barker বলেন, “Sovereignty is limited
by its own nature and its own mode of action.”
৩. স্থায়িত্ব: ছায়িত্ব হলো সার্বভৌমিকতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য। সার্বভৌমিকতার স্থায়িত্বের প্রশ্নটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। সার্বভৌমিকতা রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য উপাদান। রাষ্ট্র যতদিন টিকে থাকে, সার্বভৌমিকতাও ততদিন স্থায়ী হয়। স্থায়িত্ব হলো রাষ্ট্র ও সার্বভৌমিকতা উভয়েরই বৈশিষ্ট্য। সার্বভৌমিকতার স্থায়িত্বের উপর রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব নির্ভরশীল। রাষ্ট্রের বিলুপ্তিতেই এ ক্ষমতার অবসান ঘটে।
৪. অবিভাজ্যতা: রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা অবিভাজ্য। এ ক্ষমতাকে বিভক্ত করা যায় না। সার্বভৌমিকতা রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা। এ ক্ষমতার কেন্দ্র মাত্র একটি। এর ভাগাভাগি অসম্ভব। এ ক্ষমতার ভাগাভাগি এর বিলুপ্তিরই শামিল। Prof. Gettell যথার্থই বলেছেন, “সার্বভৌমিকতার বিভাজন একটি স্ববিরোধী ধারণা।”
৫. হস্তান্তরযোগ্য নয়: সার্বভৌমিকতা রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য উপাদান। একে হস্তান্তর করা যায় না। রাষ্ট্র তার সার্বভৌম ক্ষমতাকে কখনোই অপরের কাছে সমর্পণ করতে পারে না। অন্যথায় রাষ্ট্রের অবসান অনিবার্য। সার্বভৌমিকতা রাষ্ট্রের প্রাণস্বরূপ। যে কোন প্রাণীর পক্ষে যেমন তার প্রাণের হস্তান্তর এক হাস্যকর ধারণা, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রের পক্ষেও তার সার্বভৌমিকতার হস্তান্তর এক অবাস্তব কল্পনা। প্রাণ ছাড়া প্রাণিদেহ মৃত বলে গণ্য হয়। অনুরূপভাবে, সার্বভৌমিকতা ব্যতিরেকে রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে গার্নার বলেছেন, “সার্বভৌমিকতার হস্তান্তর আত্মহত্যার শামিল।”
৬. অনন্যতা: সার্বভৌম ক্ষমতা অনন্য। এটা শুধু রাষ্ট্রের হাতেই ন্যস্ত থাকে। রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোন প্রতিষ্ঠান সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। Prof. Mobbott বলেছেন, “অলংকার মানুষের শরীরের যেমন সৌন্দর্য বর্ধিত করে, তেমনি অনন্যতা সার্বভৌমত্বের সৌন্দর্য বর্ধিত করে।” রাষ্ট্র সার্বভৌম, তাই সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী এবং এর ফলে বাধ্যতামূলকভাবে রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকগণ আনুগত্য প্রকাশ করে।
৭. এককত্ব ও ব্যাপকত্ব: একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা এককভাবে পরিচালিত হয়। এর বিভক্তি রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে। অন্যদিকে, সার্বভৌমত্বের ধারণাটি রাষ্ট্রের সর্বত্রই ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। এটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়ে সমভাবে প্রযোজ্য।
৮. অত্যাবশ্যকতা: যে কোন রাষ্ট্রের জন্য সার্বভৌমত্ব আবশ্যক উপাদান হিসেবে বিবেচিত। সার্বভৌম ক্ষমতার বলেই রাষ্ট্র এর অভ্যন্তরে সকল প্রতিষ্ঠানের উপর কর্তৃত্বারোপ করে এবং বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। সুতরাং রাষ্ট্রের জন্য সার্বভৌমত্ব অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। তাই অত্যাবশ্যকতা সার্বভৌমত্বের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
৯. চরমতা: সার্বভৌম ক্ষমতা হলো চরম, চূড়ান্তের মতো নিরচুশ ও সীমাহীন। অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কোন শক্তির দ্বারা সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় না। রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সার্বভৌমকে মেনে চলতে বাধ্য। এ সম্পর্কে Prof. Barker বলেছেন, “Sovereignty is limited by its own nature and its own mode of action,
১০. আইনগত বৈধতা: সার্বভৌমত্বের আইনগত বৈধতা রয়েছে। এটি সার্বভৌমত্বের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আইনের মাধ্যমেই সার্বভৌমত্ব তার ক্ষমতা রাষ্ট্রের ভিতরে ও বাইরে প্রয়োগ করে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সার্বভৌমত্বের উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যাবলি ব্যাখ্যা করলে একবা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, সার্বভৌমত্ব ধারণাটি হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি। এটি রাষ্ট্রের প্রাণস্বরূপ। এটা একক, অবাধ, চূড়ান্ত এবং অবিভাজ্য ক্ষমতা। সর্বোপরি, সার্বভৌমত্ব ছাড়া রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অকল্পনীয়। Prof. Gettell যথার্থই বলেছেন, “The concept of sovereignty is the basis of modern Political Science.”