অথবা, সার্বভৌমত বলতে কী বুঝ? অস্টিনের সার্বভৌমত্ব তত্ত্বটি বিশ্লেষণ কর।
অথবা, জন অস্টিনের সার্বভৌমত্ব উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সার্বভৌমিকতার ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কমূলক। সার্বভৌমিকতার অর্থ ও প্রকৃতি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য আছে। ল্যাটিন শব্দ ‘Supcranus’ এবং ‘Sovrano’ থেকে ইংরেজি ‘Sovereignty’ শব্দটি এসেছে। এ দু’টি ল্যাটিন শব্দের অর্থ হলো ‘Supreme’ অর্থাৎ প্রধান বা চূড়ান্ত। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে সার্বভৌমিকতা বলতে এক বিশেষ ক্ষমতাকে বুঝায়। এ ক্ষমতা হলো চরম, চূড়ান্ত ও অবাধ। আর এ ক্ষমতার অধিকারী হলো রাষ্ট্র।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা: বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে কয়েকজনের সংজ্ঞা দেয়া হলো:
Prof. Raphael এর মতে, “সার্বভৌমিকতা হলো চরম ক্ষমতা এবং রাষ্ট্র এ ক্ষমতার অধিকারী। এ ক্ষমতাবলে রাষ্ট্র তার রাজ্য সীমার মধ্যে শেষ কথাটি বলে এবং চূড়ান্ত ইচ্ছা প্রকাশ করে। এটি সার্বভৌমত্বের আইনগত দৃষ্টিকোণ। এ দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রের আইনগত চরম, চূড়ান্ত ও অবাধ ক্ষমতাকেই সার্বভৌমত্ব বলা হয়।”
ষোড়শ শতাব্দীর ফরাসি দার্শনিক জ্যা বোদিন (Jean Bodin) এর মতে, “Sovereignty is supreme power over citizens and subjects, unrestrained by law.”
মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক বার্জেস (Prof. Burgess) এর মতে, “সার্বভৌমিকতা হলো সকল প্রজা ও তাদের সকল সংগঠনের উপর আদি, নিরঙ্কুশ ও সীমাহীন ক্ষমতা।”
ব্লাকস্টোন (Blackstone) এর মতে, “সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের চরম, অপ্রতিরোধ্য, শর্তহীন কর্তৃত্ব।” (The supreme,
irresistible, absolute, uncontrolled authority.)
উইলোবি (Willoughby) এর ভাষায়, “সার্বভৌমত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা।”
ফ্রেডারিক পোলক (Frederick Pollock) এর মতে, “সার্বভৌমিকতা হলো এমন এক ক্ষমতা, যা অস্থায়ী নয়, অর্পিত নয় এবং এমন কোন নিয়মের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়, যা রাষ্ট্র পরিবর্তন করতে পারে।”
‘A Dictionary of Social Science’ নামক অভিধান অনুসারে, সার্বভৌমিকতার অর্থ ।. আইন ব্যবস্থার বিধিবিধান দ্বারা প্রদত্ত আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের কর্তৃত্ব, ii. রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও নৈতিক কর্তৃত্ব, iii. ক্ষমতা চর্চার
কার্যকর উৎস কিংবা ক্ষমতা চর্চার উপর কার্যকর প্রভাব, iv. জনসাধারণের স্বাধীন, আইনগত ও নৈতিক মর্যাদা বিধান।
জন অস্টিনের সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব: সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে আইনগত মতবাদের নাম একত্ববাদ। একত্ববাদীদের মতে, সার্বভৌমত্ব হচ্ছে অবাধ, অসীম ও অবিভাজ্য ক্ষমতা। একত্ববাদ বা আইনগত সার্বভৌমত্বের প্রধান প্রবক্তা হলেন বিখ্যাত ইংরেজ আইনবিদ জন অস্টিন। ১৮৩২ সালে প্রকাশিত ‘আইনশাস্ত্রের উপর বক্তৃতামালা’ নামক গ্রন্থে তিনি আইনগত সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে তাঁর সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেন। অস্টিন সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হবসের নিরডুশ ক্ষমতাসম্পন্ন সার্বভৌমত্বের সাথে উপযোগবাদী বেস্থামের সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। ম্যাডিসন প্রমুখ নেতৃবর্গ কেন্দ্র ও রাজ্যগুলোকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সার্বভৌম বলে ঘোষণা করেন। সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে বক্তৃতা রাখতে গিয়ে জন অস্টিন মূলত তাঁর নিজের আইন তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে জন অস্টিন বলেছেন, “যদি কোন নির্দিষ্ট উর্ধ্বতন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি অপর কোন উর্ধ্বতনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করে, সে সমাজের বেশিরভাগ লোকের স্বভাবজাত আনুগত্য লাভ করে, তখন সে নির্দিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সে সমাজের সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী এবং উক্ত সমাজ একটি রাজনৈতিক ও স্বাধীন সমাজ।”
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে অস্টিনের মতবাদ শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, তা সার্বভৌমত্বের মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। তবে বহুত্ববাদীদের সমালোচনা অনুযায়ী জনমত, প্রথা প্রভৃতিকে একেবারে গুরুত্বহীন করা অস্টিনের পুরোপুরি ঠিক হয়েছে কি না এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কিন্তু একথাও সত্য যে, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যত সংঘ বা প্রতিষ্ঠানই থাককু না কেন, সেগুলোকে পুরোপুরি স্বাধীনতা প্রদান না করে তাদের উপর কিছুটা হলেও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ রাখা উচিত। গার্নার এর মতে, “সার্বভৌমিকতার আইনগত চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অস্টিনের তত্ত্ব মোটের উপর সুস্পষ্ট ও যুক্তিপূর্ণ।”