সিপাহী বিদ্রোহকে উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে গণ্য করা যায় কি-না?

অথবা, সিপাহী বিদ্রোহকে উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে গণ্য করা যা কি-না এ সম্পর্কে বর্ণনা দাও।

ভূমিকা: ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে ১৮৫৭সালের মহাবিদ্রোহ বা সিপাহী বিদ্রোহ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এ বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় প্রথম ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ। এটি সরকারি বিবরণে ‘সিপাহী’ বলে খ্যাত। পক্ষান্তরে ভারতীয় ঐতিহাসিকদের একদল একে ভারতের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন। জনগণের সমর্থনে ভারতবর্ষের সিপাহীরা এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাই একে ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ বলে আখ্যায়িত করাই যুক্তিযুক্ত।

উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ কি-না: ভারতীয় বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন অভিমত পোষণ করেছেন এবং এটি উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ কিনা সে সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মতামতগুলো ছিল নিম্নরূপ:

১. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতামত: তার মতে, ১৮৫৭সালের মহাবিদ্রোহ ছিল মূলত সিপাহীদের বিদ্রোহ। তিনি আর বলেন এটি প্রথমে সিপাহীদের দ্বারা শুরু হলেও পরবর্তীতে এটা সিপাহীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। কোথাও সিপাহীদের পশ্চাতে ছিল স্থানীয় অভিজাত শ্রেণির লোক, তালুকদার ও প্রজাদের প্রকাশ্য বিদ্রোহ। আবার কোথাও ছিল জনসাধারণের সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় অনুভূতি। ঐতিহাসিক মজুমদার এ বিদ্রোহকে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ভারতীয়দের ব্যাপক ও প্রত্যক্ষ চ্যালেঞ্জ বলে অভিহিত করেছেন।

২. এস.এন. সেনের মতামত: তিনি বলেন, “১৮৫৭ সালের আন্দোলন প্রথমে সিপাহীদের বিদ্রোহ রূপেই শুরু হয়েছিল, কিন্তু সর্বত্র এ বিদ্রোহ সিপাহীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। অযোধ্যা ও সাহাবাদ ভিন্ন অন্যত্র বিদ্রোহীদের প্রতি জনসাধারণের সমর্থন এমন কিছু ছিল না যার দ্বারা এটিকে জাতীয় সংগ্রামের পর্যায়ে উন্নীত করা যেতে পারে। তিনি এটিও মন্তব্য করেছেন যে, সকল অঞ্চলের জনসাধারণের সমর্থন ছিল সে সকল অঞ্চলের বিদ্রোহী নেতাদের লক্ষ্য ছিল “প্রতিবিপ্লব ঘটানো”।

৩. সাভারকর -এর মতামত: ঐতিহাসিক সাভারকর তার, The indian war of independence’ গ্রন্থে ১৮৫৭ সালের বিপর্যয়কে ভারতের প্রথম জাতীয় সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন।

৪. শশীভূষণ চৌধুরীর মতামত: ঐতিহাসিক শশীভূষণ চৌধুরী তার “Theories of the indian Muting” গ্রন্থে বলেছেন যে, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ সিপাহীদের বিক্ষোভ হতে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর সকল শ্রেণির মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। তিনি এই বিদ্রোহকে ভারতের ইতিহাসের এক যুগন্তকারী ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন। এই বিদ্রোহ স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

৫. সাধারণ অভিমত : ভারতীয়দের রাজনৈতিক মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার জন্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট নেতৃবর্গের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ এক স্থানে এক এক প্রকৃতি ধারন করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযোগ ও অসন্তোষই সর্বপ্রথম বিদ্রোহের দরজা উত্তোলিত করলেও এর মূলে ছিল সর্বস্তরের মানুষের গভীর অসন্তোষ ও হতাশা। ভারতে সর্বপ্রথম এই ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল বলে ১৮৫৭সালের মহাবিদ্রাহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ বা স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে কেবল সিপাহী অভ্যুত্থানই ছিল না; বরং এটি ছিল বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ। ভারতে বিদেশি শাসনের অবসান ঘটানোই ছিল এ অভ্যুত্থানের সুস্পষ্ট লক্ষ্য। সুতরাং ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ছিল বিদেশি শাসন উৎখাত করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত এক জাতীয় জাতীয় আন্দোলন। আন্দোলন।