সিমলা ডেপুটেশনের পটভূমি সংক্ষেপে আলোচনা কর।

অথবা, সিমলা ডেপুটেশনের পটভূমি বিশ্লেষণ কর।

অথবা, সিমলা ডেপুটেশনের পটভূমি কি ছিল?

উত্তর :ভূমিকা: ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনকে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। তবে ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায় নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্রিটিশ শাসনকে স্বাগত জানায় এবং সমাজে নিজেদের স্থান করে নিতে সক্ষম হন। একপর্যায়ে দেখা যায়, সকল দিক থেকে ভারতীয় হিন্দুরা স্থান করে নেয় এবং মুসলমানরা অবহেলিত বলে পরিগণিত হয়।

সিমলা ডেপুটিশনের পটভূমি: ১৯০৬ সালের সিমলা ডেপুটেশন ছিল ভারতীয় মুসলমানদের দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। নিম্নে সিমলা ডেপুটেশনের প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হলো:

১. হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় বৈষম্য: ভারতে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে হিন্দু ও মুসলিম সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়। হিন্দু ও মুসলমানদের যে ধর্মীয় পার্থক্য তা সামাজিক জীবনেও প্রতিফলিত হয়। কারণ এতে হিন্দুদের সুবিধা ছিল যে, তারা প্রথমেই ব্রিটিশ শাসনকে স্বাগত জানিয়ে সকল দিক থেকে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেন। ফলে শিক্ষা, সংস্কৃতি, বড় বড় চাকরির ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান করে নেন। অন্যদিকে মুসলমানরা প্রথম থেকে ব্রিটিশ সরকারের সংশ্রব বর্জন করেন। ফলে চাকরি, শিক্ষা সকল ক্ষেত্রে মুসলমানরা পিছিয়ে যান। তবে মুসলমানরা এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য চেষ্টায় ছিলেন।

২. ধর্মীয় জাতীয়তার উদ্ভব : উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে হিন্দু সমাজে ধর্মীয় জাতীয়তার উপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক জাতীয়তার পত্তন হয়। এ সময় অনেক হিন্দু কবি বিশেষ করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হেমচন্দ্র, নবীন চন্দ্র সেন, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চটোপাধ্যায় তাঁদের রচনার মাধ্যমে হিন্দুদেরকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেন। হিন্দুদের শিক্ষার উন্নতির জন্য কলকাতায় হিন্দু কলেজে ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলমানদের শিক্ষা গ্রহণের কোনো সুযোগ ছিল না। এছাড়া হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষার্থে ঐ সময় কিছু সমিতি যথা- ল্যান্ড হোল্ডারস সোসাইটি, বেঙ্গল ইন্ডিয়া সোসাইটি, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব সমিতির মাধ্যমে হিন্দুরা অবস্থার উন্নতি সাধন করেন। তাই মুসলমানরা নিজেদের উন্নতির জন্য পথ খুঁজতে থাকেন।

৩. মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন: ভারতবর্ষে হিন্দুরা যখন সামাজিকভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে সমাজের মধ্যে মর্যাদাবান বলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে তখন মুসলিম সমাজে কেবল চেতনাবোধ জাগ্রত হয়। এছাড়া ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর হতে আধুনিকতার আদর্শের ভিত্তির উপর মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের প্রবণতা দেখা দেয়। ১৮৬৩ সালে কলকাতায় নবাব আব্দুল লতিফ কর্তৃক মুসলমান শিক্ষা বিষয়ক সমিতি এবং ১৮৭৭ সালে সৈয়দ আমীর আলী কর্তৃক ‘কেন্দ্রীয় মোহামেডান এসোসিয়েশন’ গঠিত হলে এর সূচনা হয়। এ সমিতিগুলোতে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়।

৪. শিক্ষা বিস্তারে মুসলমানদের অগ্রগতি: ভারতবর্ষে মুসলমানরা যখন অবহেলিত তখন সৈয়দ আহম্মদ খান এর আবির্ভাব হয়। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য ভাবধারা প্রসারের লক্ষ্যে ১৮৭৭ সালে অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে আলীগড় এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এ কলেজ প্রতিষ্ঠা করে মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে
প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের সঞ্চার করার জন্য পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া তিনিই প্রথম কংগ্রেস থেকে মুসলমানদের দূরে থাকতে বলেন। শাসনতান্ত্রিক দিক থেকে তিনি মনে করবেন, ভারতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হলে সংখ্যা গুরু হিন্দুদের শাসন সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর স্থাপিত হবে।

৫. জাতীয় চেতনার উদ্ভব: ভাতরবর্ষে লর্ড কার্জন প্রশাসনিক সুবিধার অজুহাতে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ করেন। ফলে মুসলমানদের মধ্যে নতুন জাতীয় চেতনার সঞ্চার হয়। তাই তারা বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত বহাল রাখার জন্য নিজেদেরকে সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চালান।

৬. মর্লির শাসনতান্ত্রিক সংস্কার : বঙ্গভঙ্গের পর ১৯০৬ সালে মর্লি ভারতের দায়িত্ব নিয়ে আসেন। তিনি ভারতের শাসন ক্ষমতায় এসেই ভারতের শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের কথা ঘোষণা করেন। যে ঘোষণা মুসলমানদেরকে ঐক্যবোধ হতে প্রেরণা যোগায়।

উপসংহার: উপরিক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মুসলমানদের স্বার্থগত বিচারে সিমলা ডেপুটেশনকে এক মাইল ফলক বলা যায়। কারণ এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে ভারতীয় মুসলমানরা দীর্ঘদিন থেকে তাদের যে বৈষম্যের পাহাড় এর অভিজ্ঞতা তা তুলে ধরে নিজেদের স্বার্থ আদায়ের পথ সুগম করতে সক্ষম হন।