সেন্ট অগাস্টিনের গুরুত্ব আলোচনা কর।

অথবা, সেন্ট অগাস্টিনের অবদান পর্যালোচনা কর।

অথবা, রাষ্ট্র চিন্তায় সেন্ট অগাস্টিনের অবদানকে তুমি কিভাবে মূল্যায়ন করবে?

অথবা, রাষ্ট্রদর্শনে সেন্ট অগাস্টিনের ভূমিকা বর্ণনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: দর্শনের সুদীর্ঘ ইতিহাসে মধ্যযুগ একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে স্বাধীন দার্শনিক চিন্তার যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল তা মধ্যযুগের ধর্মীয় ও সামাজিক পরিবেশের প্রভাবে অনেকাংশে ব্যাহত হয়। দর্শনের অঙ্গনে সূচিত হয় সামাজিক কর্তৃত্ব ও ধর্মীয় আন্তবাক্যের অনুপ্রবেশ। সেন্ট অগাস্টিন ছিলেন এ মধ্যযুগের একজন বিখ্যাত দার্শনিক। ৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার ট্যাগাস্টি নামক স্থানে তাঁর জন্ম। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি মানী ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন, পরে ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত হন। ধর্মান্তরের ফলে তাঁর জীবনে এক আমূল পরিবর্তন আসে, যা তাঁর দর্শন চর্চাকে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর লেখা বইসমূহের মধ্যে ‘Confessions’, ‘The City of God’, ‘City of Earth’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ধর্মীয়, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিগত জীবনের সমস্ত সমস্যাই তাঁর রচনাসমূহে আলোচিত হয়েছে। প্লেটোকে তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক বলে মনে করতেন। অবশেষে তিনি ৪৩০ খ্রিস্টাব্দে পরলোকগমন করেন।

অগাস্টিনের শুরুত্ব/অবদান: পরবর্তীকালের চিন্তাভাবনায় অগাস্টিনের প্রভাব ছিল অপরিমেয়। তিনি শুধু মধ্যযুগের চিন্তার ভিত্তিই স্থাপন করেন নি, প্লেটোবাদকে তিনি শুধু খ্রিস্টীয় আদর্শের উপযোগী করেই ব্যাখ্যা করেন নি, একইসাথে তিনি খ্রিস্টায় দর্শনের এমন এক সুসংবদ্ধ রূপও দিয়েছিলেন, যা ক্যাথলিকবাদ ও প্রোটেস্ট্যান্টবাদ এ দু’য়ের উপরই প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। এজন্য দেখা যায় যে, অগাস্টিনীয় দর্শন লুথার, যুয়িঙ্গলি ও ক্যালভিন প্রমুখ প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারকের প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছিল। তাছাড়া অগাস্টিনের সমাজদর্শন পাশ্চাত্য সভ্যতার উন্মেষ ও বিবর্তনকেও প্রভাবিত করে।

তাঁর ইতিহাস দর্শন ধর্মীয় আন্দোলনসমূহেই নয়, বরং ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনেও বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। আজকের দিনের বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে যে সংঘর্ষ ও সংগ্রাম চলছে তাতেও সে একই নির্বিচারবাদ, একই ধর্মোন্মত্ততা এবং অনপেক্ষ মানদণ্ডের প্রতি একই বিশ্বাস পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন বিরোধী মতাদর্শের সংঘর্ষে সবাই যেন আজ নিজ নিজ মতাদর্শের অকাট্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত। তাই তারা চায় না অন্যের সাথে আপস করতে, অগ্রমত পরিহার করে মধ্যপথ গ্রহণ করতে।

অগাস্টিনের ঈশ্বরকেন্দ্রিক মত পাশ্চাত্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল। আধুনিক বিজ্ঞানের দ্রুত অগ্রগতির পরেও বিভিন্ন প্রকৃতবাদী মতবাদের বিস্তার সত্ত্বেও ঈশ্বরের বিশ্বাস আজও অক্ষুণ্ণ রয়েছে আধুনিক সভ্যতার অংশ হিসেবে। অগাস্টিনের সময় থেকে পাশ্চাত্যের মানুষ ক্রমবর্ধমানভাবে অন্তর্মুখী হয়ে উঠেছে। এ অন্তর্মুখী মনোভাবই আধুনিক মানুষ ও প্রাচীন গ্রিকদের মধ্যে পার্থক্যের এক বড় কারণ। প্রাচীন গ্রিকরা ভারসাম্য ও সংযমের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করতো এবং অন্তর্দর্শনকে নিন্দা করতো। কিন্তু অগাস্টিনই প্রথম ঈশ্বরের সাথে সম্পর্কিত অহং বা ‘আমি’ কে দর্শনের এক মূল সমস্যা বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অস্তিত্ববাদ ও অন্যান্য আধুনিক দার্শনিক আন্দোলন ঈশ্বরের এ ধারণাকে হয়ত গ্রহণ করে নিঃ কিন্তু অগাস্টিনের ন্যায় তারাও ব্যক্তির সমস্যাকে দর্শনের প্রধান সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছে।

এ অর্থে অস্তিত্ববাদীদের বিশ্বাস বিবর্জিত অগাস্টিনপন্থি বলে গণ্য করা যায়। আমাদের একথা উপলব্ধি করা দরকার যে, অগাস্টিন তাঁর প্রশ্নাবলির যেসব উত্তর দিয়েছেন সেগুলোতে নয়, বরং তিনি যেসব গভীর তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন, সেগুলোতেই তাঁর গুরুত্ব নিহিত। বিশ শতকে আজ আমাদের কাছে তাঁর বিশ্বতাত্ত্বিক মতকে সেকালেও অচল বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তিনি যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন, তাদের আবেদন কালজয়ী। অগাস্টিনের ন্যায় আজও আমরা নিশ্চয়তার অনুসন্ধান করি, আমাদের কার্যকলাপের পরিমাপ ও মূল্যায়নের একটি সুষ্ঠু মানদণ্ড পেতে চাই। এককথায়, আমরা বিশ্বাস করি, দর্শনকে অগাস্টিন যেভাবে দেখেছিলেন, আধুনিক মানুষের জন্যও তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অগাস্টিনকে কোনমতেই উপেক্ষা করা চলে না। কারণ পাশ্চাত্য সভ্যতার সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির পক্ষে তাঁর প্রভাব ছিল অপরিসীম। তাই F. Thilly বলেছেন, “Augustine achieved a philosophy which, although hot thoroughly systematic, touches on all the basic philosophical problems.”

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বিশ শতকে আজ আমাদের কাছে অগাস্টিনের দর্শন সেকেলে ও অচল মনে হতে পারে, কিন্তু তিনি যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন এবং যেসব মতবাদ দিয়েছেন তাঁর অবদান কালজয়ী। অগাস্টিনের দর্শন ছিল মধ্যযুগীয় আর এ মধ্যযুগীয় দর্শনের উপর দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক দর্শন। অতএব, তাঁর দর্শনের একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। তাই আধুনিক মানুষের জন্য তাঁর দর্শন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।