অথবা, স্বত্ব বিলোপ নীতি বলতে কী বুঝ? স্বত্ব বিলোপ নীতির দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে বিবরণ দাও।
অথবা, স্বত্ব বিলোপ নীতি সম্পর্কে কী জান? স্বত্ব বিলোপ নীতির দোষ-ত্রুটি ব্যাখ্যা দাও।
উত্তর: ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে লর্ড ডালহৌসি সম্রাজ্যবাদী শাসক হিসাবে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভারতীয় উপমাহাদেশে যে সকল গভর্নর জেনারেল প্রেরণ করেছেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি শুধুমাত্র সাম্রাজ্য বিস্তারই করেননি বরং বিভিন্ন ধরনের কৃতিত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পাদন করেছেন। যুদ্ধ নীতি সংগঠনে তিনি যেরূপ গৌরব লাভ করেন, শান্তি ও শাসন নীতি সংগঠনে তিনি অধিকতর গৌরবের অধিকারী হন।
স্বত-বিলোপ নীতি: লর্ড ডালহৌসি সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারায় পুষ্ট হয়ে স্বত্ব বিলোপ নীতির প্রয়োগে সর্বাধিক সংখ্যক রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। এ নতির মূল উদ্দেশ্য ছিল, ব্রিটিশ যে সমস্ত আশ্রিত ও ব্রিটিশ সৃষ্ট দেশীয় রাজ্যের উত্তরাধিকারী তা সরাসরি ইংরেজ দখলে চলে যাবে। দত্তক পুত্রের উত্তরাধিকারীর মৃত্যুর পর আশ্রিত দেশীয় রাজ্যে কোনো দত্তক পুত্রকে সিংহাসন লাভের অনুমতি দেওয়া যাবে না। কোনো রাজা অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তার রজ্য ব্রিটিশ অধিকারভুক্ত হবে। এমনকি এ যাবৎ দত্তক পুত্র গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বিশেষ অনুমতি দানের যে ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, লর্ড ডালহৌসি তাও বাতিল করেন।
স্বত্ব বিলোপ নীতির পরিণাম বা দোষ-ত্রুটি: ডালহৌসির স্বত্ব বিলোপ আইন ছিল কুটিল ও নিষ্ঠুরতাপূর্ণ এর পরিমাণ বা ত্রুটিগুলো ছিল নিম্নরূপ:
১. ডালহৌসির স্ববিরোধিতা: লর্ড ডালহৌসি নিজেই স্বত্ব বিলোপ নীতির সীমারেখা মেনে চলেননি। তিনি নির্বিচারে নির্ভরশীল ও আশ্রিত উভয় প্রকার রাজ্যের ক্ষেত্রে স্বত্ব বিলোপ আইন প্রয়োগ করেন। পরবর্তীতে গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং ভগৎ, উদয়পুর রাজ্য উত্তরাধীকারীদের ফেরত দিতে বাধ্য হন।
২. ন্যায্য সুযোগের অপব্যবহার : ডালহৌসি নিজেই মন্তব্য করেছিলেন দেশীয় রাজ্য অধিগ্রহণের জন্য ন্যায্য সুযোগ পেলে কোম্পানির তা অবহেলা করা উচিত নয়। তাই ডালহৌসি যেকোনো উপায়ে দেশীয় রাজ্য অধিগ্রহণ করতে চান, এরূপ ভীতি দেশীয় রাজাদের মনে কাজ করে।
৩. হিন্দু সমাজের প্রাচীন রীতি নস্যাৎ: অপুত্রক রাজার দত্তকপুত্র গ্রহণ ছিল হিন্দু সমাজের একটি প্রাচীন রীতি। ডালহৌসি এ অধিকার ও রীতিকে নস্যাৎ করায় দেশীয় রাজা ও প্রজারা অসন্তুষ্ট হন।
৪. বেকারত্ব সৃষ্টি: দেশীয় রাজ্যগুলো অধিগ্রহণ করায় রাজ্যের বহু কর্মচারী ও সৈনিক চাকরি হারায়। এসব চাকরিচ্যুত কর্মচারী ও সৈনিকরা তাদের পরিবারবর্গ নিয়ে নিরাশ্রয় হয়ে মহাবিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে।
৫. ভাতা ভোগী রাজাদের উপর প্রয়োগ: লর্ড ডালহৌসি দেশীয় রাজা রাজ্যের বিনিময়ে কোম্পানির ভাতা ভোগ করতেন তাদের কেও দত্তক গ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন।
৬. নির্ভরশীল ও আশ্রিত রাজ্যের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্ত: স্বত্ব বিলোপ নীতির শর্তানুযায়ী কোনো রাজ্য কোম্পনির উপর নির্ভরশীল এবং কোনো রাজ্য কোম্পানির আশ্রিত তা স্থির করা ছিল কঠিন। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের জন্য যে ডালহৌসি দায়ী ছিলেন সে সম্বন্ধে নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক মাত্রই একমত। তার পূর্ববতী শাসকগণ যেখানে ডাইরেক্টর সভার নির্দেশ সত্ত্বেও ভারতীয় চিরাচরিত্র রীতি-নীতির কথা চিন্তা করে দেশীয় রাজাদের অধিকার হরণ করেন। সেখানে তিনি ভারতীয় রীতি-নীতি বা ধর্মীয় আচার-আচরণের তোয়াক্কা না করে স্বত্ব বিলোপ নীতি যথেষ্ট প্রয়োগ করে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ডালহৌসি স্বত্ব বিলোপ নীতি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আয়তন অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছিলেন। আইন ও নীতি গতভাবে ডালহৌসির এই নীতি কখনই সমর্থন যোগ্য নয়। কারণ হিন্দু রাজাদের দত্তকপুত্র গ্রহণের অধিকার চিরদিনই স্বীকৃত ছিল। তাছাড়া এই নীতি গ্রহণ করে ডালহৌসি খুব একটা বিজ্ঞতার পরিচয় দেননি। এর ফলে রাজাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোসের সৃষ্টি হয় যা ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।