স্বত্ব বিলোপ নীতি ব্যাখ্যা কর। এটি কে প্রয়োগ করেছিলেন? এর পরিণাম কি হয়েছিল?

অথবা, স্বত্ব বিলোপ নীতি সম্পর্কে বিবরণ দাও। এই নীতি কে প্রবর্তন করেন? এর পরিণতি ফল নির্ণয় কর।

উত্তর: ভূমিকা: লর্ড ডালহৌসি ১৮১২ খ্রি. জন্মগ্রহণ করেন এবং ৩৫ বছর বয়সে তিনি ভারতবর্ষের গভর্নর নিযুক্ত হন। আকাঙ্ক্ষা কিংবা কঠোর পরিশ্রম কোনো ক্ষেত্রেই তাকে কেউই পরাস্থ কতে পারত না। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তার আট বছরের রাজত্বকাল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির দ্বারা সমৃদ্ধ ছিল। তাঁর শাসনকাল ব্রিটিশ শাসনের একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সংযোজন করেছে। কেননা এই নীতি প্রয়োগ করেই ডালহৌসি সর্বাধিক সংখ্যক রাজ্য ব্রিটিশ শাসনাধীনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।

স্বত্ব বিলোপ নীতি: সাম্রাজ্যবাদী লর্ড ডালহৌসি ছলে-বলে-কৌশলে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারে দৃঢ় প্রতিজ ছিলেন। এ উদ্দেশ্যে প্রণোদিত হয়ে তিনি যে কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করেছিলেন এদের মধ্যে তাঁর স্বত্ব বিলোপ নীতিই ছিল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। এ নীতির উদ্ভাবক না হলেও এ নীতির প্রয়োগে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এর স্বত্ব বিলোপ নীতির অর্থ হলো ইংরেজ আশ্রিত ও অনুগৃহীত কোনো দেশীয় রাজ্যের রাজা অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে তার রাজ্য সরাসরি ব্রিটিশ শাসনাধীনে আসবে। এক্ষেত্রে কোনো প্রকার দত্তক বা পালিত

পুত্রের অধিকার স্বীকার করা হবে না। কিন্তু প্রাচীন হিন্দু রীতি অনুসারে পুত্রহীন রাজাগণ তাদের রাজবংশ ও রাজ্য রক্ষা করার জন্য দত্তক পুত্র গ্রহণ করতে পারতেন। এ নীতির আলোকে ভারতীয় রাজ্য সমুহকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছিল। যথা- (ক) কোম্পানির উপর নির্ভরশীল রাজ্য, (খ) কোম্পানির সৃষ্ট আশ্রিত রাজ্য এবং (গ) স্বতানমিত রাজ্য। লর্ড ডালহৌসি তবে স্বত্ব বিলোপ নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ঘোষণা করেন,
স্বাধীন রাজ্যগুলো ছাড়া অপর দুই শ্রেণির রাজ্যের ক্ষেত্রে স্বত্ব বিলোপ নীতি কার্যকরণ হবে।

স্বত্ব বিলোপনীতি প্রয়োগকারীর পরিচয়: স্বত্ব বিলোপ নীতি প্রয়োগ করেন ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি। তিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের এক অভিজাত পরিবারের সন্তান। স্কটজাতি স্বভাবসুলভ বাস্তবতাবোধের সঙ্গে তিনি তার অভিজাতসুলভ ঐদ্ধত্যের সমন্বয়ে স্বকীয় ব্যক্তিত্বকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের বোর্ড অব ট্রেডের মহা-সভাপতি হিসেবে প্রশাসনিক কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ১৮৪৮ সালে তিনি ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত প্রাপ্ত হন এবং ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

স্বত্ব বিলোপ নীতির পরিণাম : ডালহৌসির স্বত্ব বিলোপ আইন ছিল কুটিল ও নিষ্ঠুরতাপূর্ণ। এর পরিণাম বা ত্রুটিগুলো
দিছিল নিম্নরূপ:

১. ডালহৌসির স্ববিরোধিতা: ডালহৌসি নিজেই স্বত্ব বিলোপ নীতির সীমারেখা মেনে চলেননি। তিনি নির্বিচারে নির্ভরশীল ও আশ্রিত উভয় প্রকার রাজ্যের ক্ষেত্রে স্বত্ব বিলোপ আইন প্রয়োগ করেন। পরবর্তীকালে কোনো কোনো রাজ্যের ক্ষেত্রে ডালহৌসির সিদ্ধান্ত অন্যায় প্রমাণিত হয়। পরবর্তীতে গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং ভগৎ, উদয়পুর রাজ্য উত্তরাধিকারীদের ফেরত দিতে বাধ্য হন।

২. ন্যায্য সুযোগের অপব্যবহার: ডালহৌসি নিজেই মন্তব্য করেছিলেন, দেশীয় রাজ্য অধিগ্রহণের জন্য ন্যায্য সুযোগ, পেলে কোম্পানির তা অবহেলো। করা উচিত নয়। তাই ডালহৌসি যেকোনো উপদেশীয় রাজ্য অধিগ্রহণ করতে চান, এরূপ ভীতি দেশীয় রাজাদের মনে কাজ করে।

৩. হিন্দুসমাজের প্রাচীন রীতি নস্যাৎ: অপুত্রক রাজার দত্তকপুত্র গ্রহণ ছিল হিন্দুসমাজের একটি প্রাচীন রীতি। ডালহৌসি এ অধিকার ও রীতিকে নস্যাৎ করায় দেশীয় রাজা ও প্রজারা অসন্তুষ্ট হন।

৪. বেকারত্ব সৃষ্টি: দেশীয় রাজ্যগুলো অধিগ্রহণ করায় দেশীয় রাজ্যের বহু কর্মচারী ও সৈনিক চাকরি হারায়। এসব চাকরিচ্যুত কর্মচারী ও সৈনিকরা তাদের পরিবারবর্গ নিয়ে নিরাশ্রয় হয়ে মহাবিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে।

৫. ভাতাভোগী রাজাদের উপর প্রয়োগ: লর্ড ডালহৌসির স্বত্ব বিলোপ নীতিকে নির্বিচারে প্রয়োগ করেন। এমনকি যেসব দেশীয় রাজা রাজ্য বিনিময়ে কোম্পানির ভাতা ভোগ করতেন তাদেরকেও দত্তক গ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, স্বত্ব বিলোপ নীতি ছিল ভাতরবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের একটি অজুহাত মাত্র। চরম কপটতা ও ধৃষ্টতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে ডালহৌসি একের পর এক রাজ্য অধিগ্রহণ করেন। যার ফলে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে ভারতীয় রাজারা যোগ দিয়ে ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজের ভিত নড়বড়ে করে দেয়।