স্বাধীনতা কী? স্বাধীনতার রক্ষাকবচসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলো আলোচনা কর।

অথবা, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলো আলোচনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা এ তিনটি রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শ যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গঠনের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। এ তিনটি আদর্শের মধ্যে স্বাধীনতার গুরুত্ব অনেকেই সর্বাধিক বলে মনে করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বাধীনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বাধীনতা অর্জন করা যত কঠিন, স্বাধীনতা রক্ষা করা তার চেয়েও বেশি কঠিন। তবে স্বাধীনতা রক্ষা করার ক্ষেত্রে গণতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

স্বাধীনতা: সাধারণত অপরের কাজে কোনরূপ হস্তক্ষেপ না করে নিজের কাজ সম্পাদন করার অধিকারকে স্বাধীনতা বলে। অন্যভাবে বলা যায়, স্বাধীনতা হলো অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে নিজের অধিকার সম্পূর্ণভাবে ভোগ করা।

শাব্দিক অর্থে, ‘স্বাধীনতা’ ইংরেজি শব্দ ‘Liberty’ শব্দটি ল্যাটিন মূল শব্দ ‘Liber’ থেকে উদ্ভূত। ‘Liber’ শব্দের অর্থ স্বাধীন। সুতরাং শব্দগত অর্থে স্বাধীনতা বলতে বুঝায় স্বাধীনতা ভোগ করা। অর্থাৎ ব্যক্তির ইচ্ছামতো যা খুশি করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অবাধ স্বাধীনতা স্বীকৃত হয় না। অবাধ স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারের নামান্তর। স্বেচ্ছাচারিতা স্বাধীনতাকে অবাস্তব করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, কাউকে তার খেয়ালখুশিমতো সবকিছু করার অবাধ স্বাধীনতা দিলে অপরের মানসম্মান, প্রাণ, সম্পদ কিছুই রক্ষা পায় না। ফলে উচ্ছৃঙ্খলতার এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সুতরাং অপরের অনুরূপ স্বাধীনতা ও অধিকার সংরক্ষণের জন্য প্রত্যেকের কার্যাবলি কোন না কোনভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে হবে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা: বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে স্বাধীনতার সংজ্ঞা প্রদান করেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো।

করার বাস্তব ক্ষমতা।” টি. এইচ. গ্রিন (T. H. Green) এর মতে, “স্বাধীনতা হচ্ছে উপভোগ করার উপযোগী কোনকিছু করা বা উপভোগ

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকেনী (Meckney) বলেছেন, “স্বাধীনতা বলতে সর্বপ্রকার বাধানিষেধের অনুপস্থিতি বুঝায় না, বরং অযৌক্তিক বাধানিষেধের পরিবর্তে যৌক্তিক বাধানিষেধের উপস্থিতি বুঝায়।”

অধ্যাপক গ্যাটেল (Gettell) বলেছেন, “Liberty is the positive power of doing and enjoying those things which are worthly of doing and enjoying.”

অধ্যাপক লাঙ্কি (Prof. Laski) বলেছেন, “স্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি সেসব সামাজিক পরিবেশ, যার উপর কোন বাধানিষেধ নেই এবং যা আধুনিক সভ্যতায় ব্যক্তিগত স্বাধীনতার নিশ্চয়তাস্বরূপ।” তিনি আরও বলেছেন, “স্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি সে পরিবেশ, যাতে মানুষ আত্মোন্নতি করতে যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা পায় এবং সে পরিবেশ রক্ষাহেতু অদম্য আগ্রহ প্রকাশ করে।”

স্বাধীনতার রক্ষাকবচসমূহ: স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচগুলো সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. সংবিধানে মৌলিক অধিকারসমূহ লিপিবদ্ধকরণ: সংবিধানে মৌলিক অধিকারসমূহ লিপিবদ্ধ করা এবং সেসব
অধিকার ভঙ্গের বিরুদ্ধে শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের যথার্থ ব্যবস্থা করাকে অনেকে স্বাধীনতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ বলে মনে করেন। নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হলে সেগুলো সম্পর্কে জনগণের সুস্পষ্ট ধারণা থাকে। এর ফলে অধিকারগুলো ভঙ্গ হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে তারা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে পারে। কোন সময় সরকার যদি উক্ত অধিকার ভঙ্গ করে, তবে জনগণ সাংবিধানিক উপায়ে নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে।

২. আইন: আইন স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ। আইনের মাধ্যমে স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়। কোন ব্যক্তিবিশেষের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন বা বিপন্ন হলে আইন উক্ত স্বাধীনতা রক্ষা করে। বস্তুত রাষ্ট্রীয় আইন স্বাধীনতার পূর্বশর্ত। জন লক (John Locke) এর মতে, “যেখানে আইন নেই, সেখানে স্বাধীনতার অস্তিত্ব থাকতে পারে না।”

৩. দায়িত্বশীল সরকার: দায়িত্বশীল সরকারকে স্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ বলে মনে করা হয়। এরূপ
শাসনব্যবস্থায় একাধিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব থাকার ফলে সরকারি দল কখনোই স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে না। আইভর জেনিংস (Ivor Jennings) বলেন, “দায়িত্বশীল সরকারে যেখানে বিরোধী দল সরকারকে সমালোচনা করতে পারে, সেখানে স্বাধীনতা অব্যাহত থাকে।”

৪. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: জনসাধারণের অধিকার খর্ব হলে এবং জনগণের স্বাধীনতা ব্যাহত হলে বিচার বিভাগই এর প্রতিকার করে। বিচার বিভাগকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হলে তাকে অবশ্যই আইন বিভাগ বা শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষিত হলে জনগণের স্বাধীনতাও রক্ষিত হবে।

৫. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা: স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদপত্রে নাগরিকগণ তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হলো জনগণের বাকস্বাধীনতা। এজন্যই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছাড়া নাগরিকের স্বাধীনতা সম্ভব নয়।

৬. শিক্ষার হার বৃদ্ধি: যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি ততবেশি উন্নত এবং তত বেশি স্বাধীন। তাই স্বাধীনতা রক্ষাকল্পে শিক্ষার হার বৃদ্ধি করা দরকার। অধ্যাপক লাস্কি (Prof. Laski) স্বাধীনতাকে উপলব্ধি ও উপভোগ করার জন্য জনগণের সর্বজনীন শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। তাঁর মতে, “শুধু শিক্ষার প্রসারই যথেষ্ট নয়, শিক্ষার ক্ষেত্রে শ্রেণিভেদ ও তারতম্যও দূর করতে হবে। অর্থাৎ ধনবান বা শাসকশ্রেণির সন্তানসন্ততির জন্য এক ধরনের শিক্ষা এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী বা শাসিতদের জন্য অন্য ধরনের শিক্ষা এ ব্যবস্থা দূর করতে হবে।”

৭. প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রয়োগ: প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলতে সরকার পরিচালনায় এবং আইন প্রণয়নে জনগণের প্রত্যক্ষ বা সক্রিয় ভূমিকা পালনকে বুঝায়। গণভোট, গণউদ্যোগ, পদচ্যুতি প্রভৃতি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিগুলোকে অনেকে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলে মনে করেন।

৮. ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ফলে কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক বা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর এককভাবে এবং ইচ্ছামতো ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে না। এতে ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণ সহজ হয়।

৯. জনমত: স্বাধীনতার সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ হলো সদাজাগ্রত জনমত। নাগরিকগণ সচেতনভাবে স্বাধীনতা রক্ষায় অগ্রসর না হলে উপযুক্ত ব্যবস্থাগুলো অবলম্বনে তাদের স্বাধীনতা রক্ষা করা যাবে না। তাই জনগণকে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে নিজেদেরই সচেষ্ট হতে হবে। অধ্যাপক লাস্কি তাই বলেছেন যে, “চিরন্তন সতর্কতার মধ্যেই স্বাধীনতার মূল্য নিহিত।” (Eternal vigilance is the price of liberty)

১০. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি: অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি স্বাধীনতা রক্ষার অন্যতম হাতিয়ার। অর্থনৈতিক নিরাপত্তাই কোন জাতিকে স্বাধীনতার স্বাদ দিতে পারে।

১১. সরকার ও জনগণের মধ্যে সুসম্পর্ক: স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য সরকার ও জনগণের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা একান্ত প্রয়োজন। জনগণের দ্বারা সরকার গঠিত হয়। সুতরাং উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক না থাকলে স্বাধীনতা নষ্ট হয়ে যায়।

১২. যোগ্য নেতৃত্ব: যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া স্বাধীনতা রক্ষিত হতে পারে না। তাই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যোগ্য, শিক্ষিত ও নৈতিকতাসম্পন্ন নেতৃত্ব অত্যন্ত জরুরি।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বর্তমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে প্রত্যেকটি ব্যক্তি তাদের নিজস্ব কাজকর্মে, চলাফেরায় ও অধিকার রক্ষায় স্বাধীন। Prof. Laski বলেছেন, “In democratic state liberty is the most essential thing for human rights.” তবে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রধানত যা প্রয়োজন তা হলো জনগণ ও সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা।