“স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে পাকিস্তানের বৈষম্য নীতিই দায়ী ছিল”- আলোচনা কর।

অথবা, “পাকিস্তানের বৈষম্য নীতিই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে” আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: বহু ত্যাগ তিতিক্ষা, জেল জুলুম, শোষণ, নির্যাতন সহ্য করে কঠোর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিভক্ত ও মুক্ত হলেও বাংলার ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যে আশা আর উদ্দীপনা নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটি অবিভক্ত মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে একটি শক্তিশালী ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দৃঢ় মনোবল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল, পাকিস্তানিদের কূটকৌশলের কারণে মাঝপথে এসে তার ভাটা পড়ে।

পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক নীতি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয় : পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে বাঙালিদেরকে শোষণ নিপীড়ন করত। বাঙালিরা কখনই বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক নীতি অন্যায় আচরণের প্রতিবাদই এক সময় স্বাভাবিক প্রতিবাদী আন্দোলনে রূপ নেয়। নিচে পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক নীতি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কারণ আলোচনা করা হলো:

১. সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্য পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক চক্র ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর হতেই বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির উপর পরিকল্পিতভাবে আঘাত হানতে থাকে। পাকিস্তানের অধিকাংশ লোক (পূর্ব বাংলায় ৯৮%) বাংলায় কথা বললেও উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হলে প্রতিবাদে ফেটে পড়ল বাঙালি ছাত্র জনতা। শাসক চক্রের পেটুয়া পুলিশ গুলি চালালো বাঙালি ছাত্র-জনতার উপর। শহিদ হলো সালাম, জব্বার, রফিক, বরকতসহ আরো অনেকে। অবশেষে বাঙালির বিজয় সূচিত হয় এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তখন থেকে বাঙালিরা পৃথক জাতি হিসেবে পাকিস্তানিদের নগ্ন হামলাকে বীরদর্পে দমন করে। শুধু তাই নয়, জাতীয়তার সে চেতনা ও পাকিস্তানিদের প্রতি অবিশ্বাসই ১৯৭১ সালের চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনে।

২. ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন: মুসলিম লীগের রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং পূর্ব বাংলার প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এতে আইন পরিষদের ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট লাভ করে ২২৩টি এবং মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন পায়। এ নির্বাচনের ফলাফল দেখে পাক শাসকরা বাঙালি জাতির উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং শোষণের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়।

৩. ছয়দফা কর্মসূচি ও আগরতলা মামলা: ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এ
সম্মেলনে বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সংবলিত মুক্তির সনদ হিসেবে খ্যাত ঐতিহাসিক ছয়দফা প্রস্তাব করেন। এতে পাকিস্তানিরা ক্ষিপ্ত হয়ে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রবিরোধী নায়ক হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাকে গ্রেফতার করে। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করে, যা আগরতলা মামলা নামে অভিহিত। যদিও বাঙালি জাতির চরম আন্দোলনের মুখে শেখ মুজিবসহ অন্যান্যদের মামলা প্রত্যাহার করেছিল কিন্তু ভিতরে ভিতরে শেখ মুজিবকে শায়েস্তা করার সুপ্ত বাসনা পাকিস্তানিদের মধ্যে জাগ্রত ছিল। এর সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ।

৪. অর্থনৈতিক বৈষম্য: অথনৈতিক ক্ষেত্রেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যকার বৈষম্য ছিল পর্বতসম। পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হলেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক চক্র এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সুনজরে দেখেনি। তারা শিল্প, ব্যাংক, ব্যবসায় বাণিজ্য এসব ক্ষেত্রে সবসময়ই বাঙালিদেরকে পিছিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত পণ্য অবাধে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের পণ্য রপ্তানি করে প্রাপ্ত বৈদেশিক আয় দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পকারাখানা গড়েছে। ফলে জনগণের মাথাপিছু গড় আয় যেখানে ছিল ৩৫২ টাকা সেখানে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ৫৩০ টাকা। আবার ১৯৫০-৭০ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন খাতে ব্যয় যেখানে ২,১১৪ কোটি টাকা, সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে তা ছিল ৫,৩৯৫ কোটি টাকা। এহেন শোষণ ও বঞ্চনা এবং বৈষম্যই শেষপর্যন্ত বাংলাদেশে বিপ্লবের জন্ম দেয়।

৫. ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা: ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় পরিষদের ১৬৭টি আসন লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অন্যদিকে, পাকিস্তান পিপলস পার্টি ৮৮টি আসন লাভকরে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকে। কিন্তু শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা দিতে তারা গড়িমসি শুরু করে। ১৬ থেকে ২৫ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়ার মধ্যে প্রহসনের বৈঠক চলতে থাকে। তারপর ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া ‘পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নয়, মাটি চাই’ এ ঘোষণা হানাদার বাহিনীকে দিয়ে চলে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানে যা ছিল পাকিস্তানের শেষ পরিণতির জন্য দায়ী।

৬. প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বৈষম্য: প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তানিদের অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত কম। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পাকিস্তানের প্রথম শ্রেণির মোট ২,৮১৬ জন কর্মকর্তার মধ্যে ৭৩২ জন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের। অন্যদিকে, দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের ৪৭৪১ জনের বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানের ছিলেন মাত্র ১,২৪০ জন। এরূপ বৈষম্যমূলক নীতি বাঙালিদেরকে এক পর্যায়ে ফুসিয়ে তোলে।

৭. মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে: ১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ব বাংলার মাথাপিছু আয় ছিল ২৮৫ টাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ৩৩৫ টাকা। মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে তার মাত্রা দাঁড়ায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান যথাক্রমে ৩৩০ ও ৫৩৫ টাকা। এ অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পকারখানা স্থাপনে কৃপণতা এবং সরকারের বৈষম্যমূলক বিনিয়োগ নীতি।

৮. রাজনৈতিক কারণ: ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত, পাকিস্তান বিভক্তির পর হতে বাঙালিরা রাজনৈতিকভাবে সব সময়ই বৈষম্যের শিকার হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর করাচি রাজধানী এবং জিন্নাহ পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী হওয়ার সুবাদে পুরো রাজনীতি পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ রাজনৈতিকভাবে শোষিত হতে থাকে। পাকিস্তানি সরকার দীর্ঘ নয় বছরে জাতিকে একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান উপহার দিতে ব্যর্থ হয়। ১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত কোনো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে হক সাহেবের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠন করলেও নানা অজুহাতে তা ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রের শাসন জারি করা হয়।

৯. বিনিয়োগ ও বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে: প্রথম পরিকল্পনায় সমস্ত বিনিয়োগের মাত্র ২৬% পূর্ব বাংলার জন্য নির্ধারণ করা হয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এর অবস্থা ছিল যথাক্রমে ৩১% ও ৩৭%। বৈদেশিক সাহায্যের সিংহভাগ ব্যয়িত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে আর পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যে জুটেছে শুধু আশ্বাসের বাণী।

১০. সামরিক কারণ: সামরিক দিক দিয়েও পূর্ব পাকিস্তান অনেক পিছিয়ে ছিল। সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের সংখ্যা ১০% এর কম। অথচ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থার বিচারে এখানে একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তোলা উচিত ছিল, কিন্তু তা করা হয়নি। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয়।

উপসংহার: পরিশেষে দেখা যাচ্ছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আন্তরিকতা এবং সহযোগিতা সত্ত্বেও শুধু পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতন, শোষণ, আর অহমিকার জন্য এদেশের জনগণ বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য হয়। শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণেই নয়, পাকিস্তানের মাঝে আরো কিছু ধারণা ছিল সেগুলোও বাঙালিদের প্রতি তাদের বৈষম্যের গতি ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করেছে। এসব কারণে পূর্ব বাংলার জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে ছিনিয়ে আনে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।