স্যার সৈয়দ আহমদ খানের রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে যা জান লিখ।

অথবা, স্যার সৈয়দ আহমদ খানের রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্ক বলতে কী বুঝ?

অথবা, স্যার সৈয়দ আহমদ খানের রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দাও।

উত্তর: ভূমিকা: ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের নবজাগরণের অগ্রদূত ছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান। ব্রিটিশ শাসননীতির প্রভাবে পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজকে কুসংস্কার মুক্ত করা এবং মুসলমানদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার মানসে তিনি আলীগড় আন্দোলন পরিচালনা করেন। তার পরিচালিত আলীগড় আন্দোলন যে সকল মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছিল তার মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শগুলো ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সৈয়দ আহমদ খানের পরিচয়: স্যার সৈয়দ আহমদ খান ১৮১৭ সালের ১৭ অক্টোবর দিল্লির এক প্রখ্যাত সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ মুহাম্মাদ তর্কী। ১৮৮৮ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খান তার কর্মকান্ডের জন্য ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নাইট কমান্ডার অব দি স্টার অব ইন্ডিয়া উপাধিতে ভূষিত হন। তখন থেকেই তিনি স্যার সৈয়দ আহমদ বলে খ্যাত হন। ১৮৯৮ সালের ২৭ মার্চ তিনি মারা যান।

সৈয়দ আহমদ খানের রাজনৈতিক মতাদর্শ: সৈয়দ আহমদ খানের রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে I.H Gureshi মস্ত ব্য করেছেন, “The political awakening was imperative that the British must be cultivated as friends and that it was not in the interests of the Muslims to join the congress” [I.H. Qureshi The struggie for pakistan P-20].

নিম্নে তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শের ধারণাগুলো উল্লেখ করা হলো:

১. গণতন্ত্রের পক্ষে মতামত: স্যার সৈয়দ আহমদ খান সর্বদাই গণতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন। তিনি ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখার পক্ষে মতামত প্রকাশ করেন।

২. সিপাহী বিদ্রোহ ও মুসলমানদের ভ্রান্ত ধারণা: ১৮৫৭সালের সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার পিছনে ভারতীয়দের অজ্ঞতা ও ব্রিটিশ নীতি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণাই কাজ করেছিল বলে মনে করেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান। তিনি সবার মাঝে প্রচার করেন যে, শাসক ও শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক ব্যতীত কোনো জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি Loyal Mohammadan of India তে এ ধারণার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেন। এছাড়া ১৮৬৬ সালে তিনি তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে আলীগড় British India Association গড়ে তোলেন। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি জনগণের মাঝে তাঁর মতবাদ প্রচার করেন এবং সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানান।

৩. কংগ্রেসের নীতি ও ভারতীয় মুসলমানদের অবস্থান: AII India National Congress ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হিন্দু-মুসলিম উভয়ের স্বার্থরক্ষায়। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই কংগ্রেসের ধারা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। বেনারসের হিন্দু কংগ্রেসের সদস্যরা এ সময় সিদ্ধান্ত নেন যে, সরকারি অফিস আদালতে ফার্সি বর্ণমালায় লিখিত উর্দু ভাষার পরিবর্তে দেবনাগিরি বর্ণে লিখিত হিন্দি ভাষা ব্যবহার করা হবে। এমতাবস্থায় সৈয়দ আহমদ বুঝতে পারেন যে, বিচার বিভাগ থেকে মুসলমানদের আয়ের পথ বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই এ নীতি চালু করা হচ্ছে এবং পরবর্তীতে কংগ্রেস হয়ত বা এমন কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে যা ব্রিটিশ বিরোধী। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে মুসলমানরাই। তাই তিনি মুসলমানদেরকে কংগ্রেস থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন।

৪. প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বিরুদ্ধাচরণ: সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রচলন করেছিল স্যার সৈয়দ আহমদ ছিলেন তার ঘোর বিরোধী। কেননা তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে ইংরেজ শাসনামল শুরু হওয়ায় হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে মুসলমানদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষা বর্জন করে অনেক বেশি পিছিয়ে পড়েছে। যার ফলে প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি কর্মচারী নিয়োগ দিলে হিন্দুরাই চাকরিগুলো অধিকার করবে। তাই তিনি এ ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী ছিলেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, স্যার সৈয়দ আহমদ ৩৯ আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমান সমাজের যাবতীয় কুসংস্কার দূর করে তাদের আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় শামিল করেছিলেন। এ আন্দোলনের ফলে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমানরা নিজেদের আলাদা একক স্বাধীন সত্তা হিসেবে ভাবতে শেখে এবং স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র গঠনের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামের অনুপ্রেরণা লাভ করে। তাই ভারতবর্ষের মুসলমানরা নিজেদের উন্নয়ন ও পরিবর্তনে সৈয়দ আহমদ খানের নিকট আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে।