১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণগুলো আলোচনা কর।

অথবা, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণগুলো সম্পর্কে বর্ণনা দাও।

অথবা, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণগুলো সম্পর্কে ব্যাখ্যা দাও।

উত্তর: ভূমিকা : উপমহাদেশের ইতিহাসে ‘British East india company’-র বিরুদ্ধে সংঘটিত ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন। এ বিদ্রোহ ছিল পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তী একশ বছরের ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের চরম পরিণতি। ১৮৫৭ সালের এ বিদ্রোহ কোম্পানির সেনাদের মধ্যে শুরু হয়ে তা ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিদ্রোহ কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও জাতীয় চেতনাকে জাগ্রত করে ছিল সফলভাবে।

সিপাহী বিদ্রোহের রাজনৈতিক কারণ: ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন ও শোষণকে সুদৃঢ় ও স্থায়ীকরণের লক্ষ্যে ব্রিটিশ শক্তি ছলে বলে কৌশলে রাজনীতির কালো থাবা বিস্তার করে চলেছিল, যা মহাবিদ্রোহের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। এ বিদ্রোহের রাজনৈতিক কারণ ছিল নিম্নরূপ:

১. দেশীয় রাজন্যবর্গের ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব ‘স্বত্ত্ব বিলোপ নীতির প্রতিক্রিয়া: ১৮৫৭ সালের বহু পূর্ব হতে দেশীয় রাজন্য বর্গ উত্তরোত্তর ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠতেছিল। লর্ড ডালহৌসি স্বত্ব বিলোপ নীতির মূল কথা ছিল কোনো রাজা অপুত্রক অবস্থায় মারা যায় তাহলে তার রাজ্য সরাসরি ইংরেজ সাম্রাজ্যভুক্ত হবে। কোনো রাজা দত্তক পুত্র গ্রহণ করতে পারবে না। যদি থাকে তবে তার অধিকার থাকবে না।

২. রাজ্যবিস্তার নীতি: পলাশীর যুদ্ধের পর লর্ড ডালহৌসি ক্ষমতায় এসে সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি গ্রহণ করে। ইংরেজরা প্রথমে দেশীয় রাজ্যগুলোর সাথে সম্ভাব বজায় রাখার নীতি গ্রহণ করলেও পরে কোনো রাজ্য তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি অস্বীকার করলে এক পর্যায়ে জোরপূর্বক রাজ্য দখলনীতি গ্রহণ করে।

৩. আশ্রিত রাজ্যে কুশাসন : আশ্রিত রাজ্যসমূহে কুশাসনের ফলে মহাবিদ্রোহের পূর্বে কয়েকটি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে ত্রিবাডুরের দেওয়ান ডেপু তাম্পি বিদ্রোহী হয়ে কালিকটের রাজাকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে চেষ্টা করে। ১৮১৫-১৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বাজীরাও কাথিয়াবাড়ের রাজপুত রাজন্যবর্গকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছিলেন। ১৮২৪-২৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্ম যুদ্ধে ব্রিটিশের পরাজয়ে উৎসাহিত হয়ে ভারতের “বিক্ষুদ্ধ শ্রেণি” ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। ভূ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রতিশোধ গ্রহণার্থে ঝরিজার সর্দাররা সিন্ধুদেশের আমীরদের সহযোগিদায় বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

৪. আদিম জাতিগুলোর বিক্ষোপ : আদিম জাতিগুলোর মধ্যেও ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব প্রবল হয়ে উঠেছিল। ১৮৩১-৩২ সালে সংঘটিত কোনো অভ্যুত্থান আদিম জাতিগুলোর ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবের চরম নিদর্শন। সিংভূমের কোলারী, মানভূমের ভূমজী, উড়িষ্যার খন্দ, খান্দেশের ডিল, রাজমহলের সাঁওতাল প্রভৃতি আদিম জাতিগুলো অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল।

সামাজিক কারণ মহাবিদ্রোহের সামাজিক কারণের বিভিন্ন দিক ছিল নিম্নরূপ:

১. ভারতবাসীর প্রতি ইংরেজদের দুর্ব্যবহার: ভারতীয় জনসাধারণের সামাজিক অসন্তুষ্টি ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের জন্যে দায়ী ছিল। ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই ভারতবাসীর প্রতি শাসনবর্গের ঘৃণার মনোভাব এদেশবাসীর মনে গভীর বেদনা ও হতাশার সৃষ্টি করেছিল। জনৈক ঐতিহাসিকের মতে, “ইংরেজগণ ইচ্ছা করেই ভারতবাসীর সংস্পর্শ বর্জন করে চলত।

২. মধ্যবিত্ত ও উচ্চ শ্রেণিতে বেকারত্ব বৃদ্ধি: ভারতীয় সমাজের মধ্যবিত্ত ও উচ্চ শ্রেণিভুক্তরা বিশেষ করে শিল্পী, সাহিত্যিক ও ধর্মপ্রচারকরা ব্রিটিশ সরকারের শোষণে নিপতিত হয়ে সকল উচ্চ ও দায়িত্বশীল পদ হতে বঞ্চিত ও পদচ্যুত হয়। এভাবে পদচ্যুত হয়ে বেকারে পরিণত হলে তাদের মধ্যে ক্ষোভও অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠে।

৩. সংস্কারসমূলক কাজে সন্দেহপোষণ: হিন্দুগণ বহু প্রাচীনকাল থেকে তাদের সামাজিক অনুশাসনগুলো অত্যধিক সর্তকতার সাথে প্রতিপালন করে এসেছিল। আইন পাস করে সতীদাহ প্রথার বিলোপসাধন বিধবা বিবাহের প্রচলন, ইংরেজি শিক্ষা, রেলগাড়ি এবং টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার প্রবর্তন ভারতবাসীকে বিচলিত করে তোলে।

৪. জনগণের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার: খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের খ্রিস্টধর্ম প্রচার, ধর্মান্তরিত ভারতীয়দের জন্যে পৈত্রিক সম্পত্তি ভোগের অধিকার প্রদান, ভারতীয় নর-নারীদের প্রতি ব্রিটিশ শাসকদের অকথ্য অত্যাচার ও নির্যাতন ভারতবাসীকে ব্রিটিশ বিদ্বেষী করে তোলে। এরূপ পরিস্থিতিতে ভারতীয় সিপাহী ও জনসাধারণকে ধূমায়িত করে সিপাহী বিদ্রোহকে তরান্বিত করে।

৫. ভারতবাসীর প্রতি ঘৃণা: বিভিন্ন প্রকার গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, ব্রিটিশরা ইচ্ছা করেই ভারতবাসীর সংস্পর্শ বর্জন করে চলত এবং ভারতীয়দেরকে বর্বর বলে মনে করত। ১৭৭৮ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস স্বয়ং এরূপ স্বীকার করেছেন যে, কিছুকাল আগেও বেশির ভাগ ইংরেজরা ভারতীয়দেরকে মোটের উপর বর্বর বা বার্বার বলে মনে করতো। ভারতবাসীর প্রতি ইংরেজদের এরূপ ঘৃণার মনোভাব ভারতীয়দের মনে গভীর বেদনা ও ক্ষোভের সঞ্চার করে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে. ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে ব্রিটিশ সরকারের কঠোর দমন নীতির ফলে এ বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে যায়। সিপাহী জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সংঘটিত এই বিদ্রোহ ছিল ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদের প্রথম পদক্ষেপ।