অথবা, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে বাংলার বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি কার্যাবলী আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সিপাহীদের অংশগ্রহণের মূলে ছিল তাদের প্রতি কোম্পানির বিভিন্ন বৈষম্যমূলক নীতির ফলশ্রুতি। অর্থনৈতিক অবস্থানগত দিক দিয়ে তখন বাংলায় তিনটি প্রধান সামাজিক শ্রেণির অবস্থান লক্ষণীয় ছিল। যেমন কৃষক ও শ্রমিকসহ সাধারণ জনগণ, বণিক ও শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং ভূমিতে স্বার্থসংশ্লিষ্ট শ্রেণি তথা জমিদার ও ভূ-স্বামী।
সামাজিক শ্রেণির ভূমিকা: ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলার বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির ভূমিকা নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. সাধারণ জনগণ, কৃষক ও শ্রমিকদের ভূমিকা: বাংলার সাধারণ জনগণ, কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি সর্বদাই নিজেদেরকে ১৮৫৭ সালের যুদ্ধ থেকে বিছিন্ন করে রেখেছিল। যুদ্ধের সময়ে তারা নিরাপদ আশ্রয়ে নিরুপদ্রবে বাঁচতে চেয়েছে। সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কায়-জনগণ তাদের স্ত্রী-পরিজনসহ পালিয়ে যায়। কোম্পানির সৈন্যদের অত্যাচার থেকে অব্যাহতির জন্য শ্রমজীবী জনগণ কোম্পানিকে সহযোগিতা দান থেকে বিরত থাকে।
২. বণিক সম্প্রদায় ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা: ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলার বণিক সম্প্রদায় ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি কোম্পানির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বণিক সম্প্রদায় তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থরক্ষা ও বাণিজ্যিক স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যেই কোম্পানিকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে। বণিক সম্প্রদায়ের ন্যায় যুদ্ধের সময় কোম্পানির সাথে সহযোগিতা ও যোগাযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রত্যক্ষভাবে সিপাহীদের বিরোধিতা করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রত্যক্ষভাবে কোম্পানির সাথে সহযোগিতা করে। তারাই এক্ষেত্রে অগ্রণী ছিল।
৩. জমিদার ও ভূ-স্বামীদের ভূমিকা: ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলার জমিদার ও ভূ-স্বামীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলায় ভূ-স্বামীরা সিপাহী বিদ্রোহ দমনে কোম্পানিকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে। ভূ-স্বামীরা অনুধাবন করেছিল যে সিপাহী বিদ্রোহের মাধ্যমে বিদ্রোহ দমনে কোম্পানিকে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক স্বার্থের উপর চূড়ান্ত আঘাত অবশ্যম্ভাবী হতে পারে। জমিদার ও ভূ-স্বামী বিরোধী প্রজা বা সাধারণ জনগণের সিপাহী বিদ্রোহের প্রতি সমর্থন ও বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করার কথা চিন্তা করে জমিদার ও ভূ-স্বামীরা কোম্পানিকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সামরিক নীতি সিপাহীদের স্বার্থের পরিপন্থি হওয়ায় সর্বপ্রথম মঙ্গল পাণ্ডের নেতৃত্বই বাংলায় ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। শুধুমাত্র কোম্পানির কারণে নয়, এদেশীয় কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ জনতার নির্লিপ্তায় যেমন বিদ্রোহ সর্বাত্মক রূপ লাভকরেনি তেমনি স্বার্থবাদ বণিক ও মধ্যবিত শ্রেণি এবং জমিদার ও ভূ-স্বামীদের কোম্পানির প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সমর্থন দান বাংলায় বিদ্রোহ দমনের পথ সুপ্রশস্ত করে।